স্তব্ধ: দেওয়ালে লেখা দুলালের ছোট ছেলের নাম। বসে রয়েছেন মা সুকুরমণি। ছবি: সুজিত মাহাতো
ওই বোধ হয় মোটরবাইকের হেড লাইটটা অন্ধকার ফুঁড়ে দেখা যাবে। এই অপেক্ষাতেই কোটা ঘরের এক চিলতে জানলা থেকে অন্ধকার গাঁয়ের পথের দিকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছিলেন তরুণীটি।
সময় পেরিয়ে গিয়েছে, ক্লান্তিতে চোখ জুড়ে এসেছে বারবার। কিন্তু, গাড়ির হেড লাইটের আলো এসে পৌঁছয়নি বলরামপুরের ডাভা গ্রামে বিজেপি নেতা দুলাল কুমারের বাড়ির সামনে।
দুলালও ফিরলেন না। অজানা আশঙ্কায় কোঠা ঘর আর নীচে ওঠানামা করতে করতে রাত কাটালেন তাঁর স্ত্রী মনিকা। শনিবার সকালে সেই বাড়িতে খবর এল— সব শেষ।
সেই থেকে ঘরের আধো অন্ধকার ঘরেই ঠাঁই নিয়েছেন মনিকা। তিন নাবালক সন্তানের মা মনিকা কখনও মেজ মেয়ে চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া পূজাকে, কখনও বা দ্বিতীয় শ্রেণির পড়ুয়া ছোট ছেলে আদর্শকে আঁকড়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কেঁদেছেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতি দিন রাত সাড়ে আটটার মধ্যেই স্বামী বাড়ি ফিরত। কিন্তু, শুক্রবার না ফেরায় সবাই যখন খুঁজতে বেরোয়, আমি কোঠায় উঠে জানলা দিয়ে দেখছিলাম, যদি তার মোটরবাইকের আলো দেখতে পাই। কিন্তু, মানুষটা এল না। সারা রাত আমরা তো বটেই, বাচ্চাগুলোও ঘুমাতে পারেনি। এই তিনটে সন্তানকে কী করে মানুষ করব আমি, কূলকিনারা পাচ্ছি না।’’
বাড়ির দাওয়ায় তখন নিজের সন্তানকে হারানোর শোকে বিলাপ করছেন প্রৌঢ়া মা সুকুরমণি। উনুনের পাশে তখনও থালায় পড়ে শুকনো ভাত, ঢেঁড়শ ভাজা ও আলুর সব্জি। সে দিকেই তাকিয়ে ছলছল চোখে তিনি আক্ষেপ করছিলেন, ‘‘ছেলেটা বলেছিল, ফিরে এসেই সবার সঙ্গে খাবে। ভাত বেড়ে রেখেছি। শুধু সেই ফিরল না। আমরাও দাঁতে কাটতে পারিনি।’’
দুলালের পরিবার, পরিজনদের মতোই তাঁর দলের কর্মীরাও এই মৃত্যু কোনও ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তাঁদের মধ্যে বাবলু রজক, কড়মু কুমার, জিতু গোপেরা বলছিলেন, ‘‘রাত আটটার পরে গ্রামের রাস্তা থেকে একটা মানুষকে আততায়ীরা তুলে নিয়ে গিয়ে ঝুলিয়ে দিল! ভাবা যায় না।’’
নিহত দুলালের বাবা মহাবীর কুমার, জেঠতুতো ভাই রূপচাঁদ কুমার বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার দুলাল মোটরবাইকে সকালে বাঘমুণ্ডিতে পিসির বাড়ি গিয়েছিল। তখন ওই রাস্তায় দুয়ারসিনির মোড়ের কাছে দু’জন বহিরাগত ওকে আটকে হুমকি দেয়, ‘খুব বিজেপি করছিস’। তাদের এড়িয়ে দুলাল কোনও ভাবে বেরিয়ে যান। সেই ঘটনার কথা দলের লোকেরা মৌখিক ভাবে পুলিশকে জানিয়েছিল। কিন্তু, তারই মধ্যে এমন হয়ে যাবে ভাবিনি।’’
হুমকি সত্ত্বেও দুলাল মঙ্গলবার রাত সাড়ে সাতটায় তাঁর বাবাকে খাবার দিতে গিয়েছিলেন, বাড়ি থেকে আধ কিলোমিটার দূরে বলরামপুর-বাঘমুণ্ডি রাস্তার পাশে নিজেদের মুদির দোকানে। সেই দোকানের সামনের তক্তপোশেই বিজেপি নেতা-কর্মীদের ওঠাবসা ছিল। সেখান থেকে ফেরার পথেই তাঁকে আততায়ীরা অপহরণ করে বলে অভিযোগ।
মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই জেলার বিভিন্ন এলাকায় পথ অবরোধ শুরু করে বিজেপি কর্মীরা। আশপাশের গ্রাম ভেঙে পড়ে দুলালের দেহ যেখানে আছে, সেই এলাকায়। পুলিশ দেহ উদ্ধার করতে গেলে বাধা দেওয়া হয়। দাবি করা হয়, পুলিশ-কুকুর নিয়ে আসতে হবে। পরে পুলিশ বাহিনী যায়। পুলিশকে ঘিরে তুমুল বিক্ষোভ চলে দফায় দফায়। বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ পুলিশ-কুকুর এসে গ্রামের কিছুটা দূর পর্যন্ত ছুটে যায়। পুকুরের ঘাটে গিয়ে থমকে যায় কুকুরটি। তাতে সন্তুষ্ট না হলে জনতা দেহ আটকে রাখে। ঘটনাস্থলে আসেন জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী, বলরামপুর ব্লক নেতা বানেশ্বর মাহাতোরা।
বিদ্যাসাগরবাবুর অভিযোগ, ‘‘জেলায় তৃণমূলের সব থেকে খারাপ ফল হয়েছে বলরামপুরে। কোণঠাসা হয়ে পড়া তৃণমূল বলরামপুরে মাথা তুলতে সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু করেছে। তৃণমূল-আশ্রিত দুষ্কৃতীরাই এই কাজ করছে।’’ তবে নিহতের বউদি সীমার ধারণা, ‘‘স্থানীয় লোকজন সঙ্গে না থাকলে আততায়ীরা এলাকায় খুন করার সাহস পাবে না।’’ বিদ্যাসাগরবাবুরা সিবিআই তদন্তের দাবি করেছেন। বলরামপুরের ওসিকে সরানোর দাবি তুলেছেন।
এ দিন নিহত দুলাল ও ত্রিলোচনের বাড়িতে সমবেদনা জানাতে যান সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীননাথ লোধা। তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘বাম আমলে তৃণমূল যে ভাবে জঙ্গলমহলকে রক্তাক্ত করেছিল, সেই পরিবেশ তারা ফিরিয়ে আনছে। রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেই আমরা এসেছি।’’ যদিও সেই অভিযোগ মানতে চাননি তৃণমূল নেতৃত্ব।
জেলা জুড়ে আজ, রবিবার ১২ ঘণ্টা বন্ধের ডাক দিয়েছে বিজেপি। তার আগেই এ দিন বলরামপুর ব্লক সদর ছিল থমথমে। মোড়ে মোড়ে একই আশঙ্কা— বলরামপুরে এ কী দিন শুরু হল? শান্তি ফেরার দাবি উঠেছে সব মহলেই।