বহিরাগত হটাতে চায় না কোনও দল

যাদবপুরে অশান্তির পিছনে বহিরাগতদের ভূমিকার কথা শনিবারেও জোর দিয়ে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। বস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বহিরাগতদের উপস্থিতির জেরে অশান্তির ঘটনা নেহাত কম নয়। এবং সেই বহিরাগতদের বেশির ভাগই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০২:৩৯
Share:

যাদবপুরে অশান্তির পিছনে বহিরাগতদের ভূমিকার কথা শনিবারেও জোর দিয়ে বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। বস্তুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে বহিরাগতদের উপস্থিতির জেরে অশান্তির ঘটনা নেহাত কম নয়। এবং সেই বহিরাগতদের বেশির ভাগই কোনও না কোনও রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকেন। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের জন্য অশান্তি হলেই রাজনৈতিক দলগুলি মোটামুটি এক সুরে জানায়, তারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশের বিরোধী। কিন্তু ওই পর্যন্তই! তার পরেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আনাগোনা অব্যাহত বহিরাগতদের।

Advertisement

অথচ ব্যতিক্রম রয়েছে। অল্প হলেও।

সেন্ট জেভিয়ার্স, রামকৃষ্ণ মিশনের কলেজগুলি তো বটেই, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়া আইআইইএসটি (আগের বেসু)-ও রয়েছে এই তালিকায়। জোকায় রয়েছে আইআইএম, খড়্গপুরে আইআইটি। সেখানে পড়ুয়া আছেন, পঠনপাঠনও আছে। কিন্তু কথায় কথায় বিক্ষোভ-ঘেরাও-সঙ্ঘর্ষ নেই। কোনও রাজনৈতিক দলের অঙ্গুলিহেলনে চলা ছাত্র ইউনিয়নও নেই।

Advertisement

এ সব দৃষ্টান্ত পছন্দ নয় রাজ্যের প্রায় কোনও ছাত্র সংগঠন বা তাদের নিয়ন্ত্রণকারী দলের। তাদের কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানে দলের নেতা-কর্মী গড়ার সম্ভাব্য কারখানা। তাই, ছাত্রভর্তি, ছাত্র সংসদ নির্বাচন তো বটেই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভিতরে পিন পড়লেও তার শব্দ শোনা যায় চৌহদ্দির বাইরে রাজনৈতিক দলের দফতরে! তার পরে সেখানকার পরিকল্পনা মতোই নিয়ন্ত্রিত হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের ঘটনাবলি।

প্রবীণ শিক্ষকদের অনেকের মতে, এ রাজ্যে দীর্ঘলালিত ঐতিহ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা সুযোগ মিলেছিল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গঠিত লিংডো কমিটির সুপারিশের হাত ধরে। সাধারণ ভাবে রাজনৈতিক দলগুলির মূল লক্ষ্য থাকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদগুলির দখল নেওয়া। সেই কারণেই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নির্বাচন কার্যত সাধারণ নির্বাচনের চেহারা নেয়। ছাত্রদের হাত ধরে রাজনৈতিক দলগুলি প্রকাশ্যেই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়ে।

লিংডো কমিটির সুপারিশ ছিল, ছাত্র সংসদের নির্বাচনকে পুরোপুরি রাজনৈতিক সংস্রব মুক্ত করতে হবে। নির্বাচনের সময় বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। এমনকী, সত্যিকারের পড়ুয়ারাই যাতে ছাত্র সংসদের প্রতিনিধি হতে পারেন, সে দিকে খেয়াল রেখে কমিটির সুপারিশ ছিল, নির্বাচনে প্রার্থী হতে গেলে ক্লাসে ৭৫ শতাংশ হাজিরা থাকতেই হবে। কমিটি এ-ও বলেছিল, স্নাতকে ১৭-২২ বছর এবং স্নাতকোত্তরে ২৪-২৫ বছরের ছাত্রছাত্রীরাই প্রার্থী হতে পারবেন।

২০০৬ সালে লিংডো কমিটি তাদের সুপারিশ জানানোর পরে তা কার্যকর করার কোনও চেষ্টা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে হয়নি। আসলে বাম আমলে কার্যত রাজ্যের প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রিত হয়েছে আলিমুদ্দিন থেকে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে ঘোষণা করেছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনীতির অনুপ্রবেশ তারা বন্ধ করবে। কিন্তু বাস্তবে স্থানীয় নেতা থেকে মন্ত্রী এবং দলের নানা স্তরের অনুগামীদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রেও এখন কার্যত তৃণমূল ভবনই শেষ কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকী, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে রাজ্য উচ্চশিক্ষা সংসদ একটি সুপারিশ তৈরি করলেও দফতর সূত্রে খবর, শাসক দলের ছাড়পত্র মেলেনি বলে সেই সুপারিশ আজও ফাইলবন্দি।

আর এই পরিস্থিতিতে শাসক দলের ছাত্র সংসদ (অনেক সময়ই বহিরাগতদের বলে বলীয়ান হয়ে) একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দাপাদাপি করেছে। টিএমসিপি-র কার্যকলাপে বিব্রত হয়ে এক সময় সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কলেজে বহিরাগতদের প্রবেশ বন্ধ করার পক্ষে জোরালো সওয়ালও করেছেন তিনি। কিন্তু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই সব ঘটনাকে, ‘ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুল’ বা ‘ছোট ঘটনা’ বলে লঘু করে দিয়েছেন। ফলে পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।

কিন্তু মিশনারি কলেজগুলির ঐতিহ্যের কথা ছেড়ে দিলেও, একেবারে হাল আমলে বেসু তো পেরেছিল! তা হলে অন্যদের ক্ষেত্রে বহিরাগতের প্রবেশ বা রাজনীতির রং সরিয়ে রেখে ছাত্রদের জন্য প্রকৃত অর্থেই ছাত্রদের পরিচালিত কলেজ ইউনিয়ন কি সম্ভব নয়?

প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমলকুমার মুখোপাধ্যায় মনে করেন, সেটা হতে পারে যদি ছাত্ররা চায়, তা হলেই। অমলবাবুর কথায়, “কেবল মাত্র ছাত্রদের জন্য এবং ছাত্রদের দ্বারা ছাত্র সংসদ গঠিত হওয়া উচিত, যাতে কোনও ভাবেই দলীয় রাজনীতির রং থাকবে না। এবং এটাই আদর্শ ব্যবস্থা। লন্ডনে ছাত্র ইউনিয়নগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাইরের খবরদারি মানে না। ফলে বহিরাগতদের উৎপাতও নেই!”

আইআইএম কলকাতার শিক্ষক অনুপ সিংহ মনে করেন, এটা এক দিকে নির্ভর করে ছাত্রছাত্রীরা দলীয় রাজনীতির দ্বারা নিজেদের কত দূর প্রভাবিত বা পরিচালিত হতে দেবেন, তার উপরে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক অবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ সব কিছুই জড়িয়ে রয়েছে এর সঙ্গে। তিনি বলেন, “এমনও দেখা যায়, যেখানে খুবই সাধারণ পড়ুয়াদের ভিড়, সেখানে স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব কিছু বেশি। রাজনৈতিক নেতা বা দলের উপরে তাদের নির্ভরতা বেশি। তবে অনেকটাই নির্ভর করে কর্তৃপক্ষের ভূমিকার উপরে। তিনি বা তাঁরা বাইরের রাজনীতি দ্বারা কতটা প্রভাবিত, তার উপরেও পরিস্থিতির প্রবাহ অনেকটা নির্ভর করে।”

রাজনৈতিক দলগুলির কী বক্তব্য? রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান, তাঁদের দল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ অনুমোদন করে না। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিমও জানিয়েছেন, তাঁরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের প্রবেশ চান না। কিন্তু ঘটনা হল, বাম জমানার দীর্ঘ ইতিহাসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের প্রবেশে কোনও নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কংগ্রেস নেতা মানস ভুঁইয়া জানান, মেডিক্যালে পড়ার সময়ে তিনি ছাত্র রাজনীতি করেছেন। কিন্তু চেষ্টা করেও সব সময় বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ রুখতে পারেননি। আর রাজ্য রাজনীতিতে সম্প্রতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ মনে করেন, তাঁদের দল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহিরাগত ঢোকায় না।

সবাই বলছেন, তাঁরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ চান না। কিন্তু এক বারও বলছেন না, দলীয় রাজনীতির রং থেকে দূরে থাকুক ছাত্রসমাজ। যে দলীয় রাজনীতির হাত ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনুপ্রবেশ ঘটছে বহিরাগতদের।

তাই রাজ্য রাজনীতিতে ভারসাম্যের বদল হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বহিরাগতদের আসা-যাওয়ার বদল হয় না!

প্রতিবাদের পথ... সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন