ইলিশের বাচ্চা। নিজস্ব চিত্র
স্বাদগন্ধের বিশিষ্টতা দূরের কথা। তখনও তারা চেহারায় এতটা পরিণত হয়ে ওঠে না যে, তাদের গোত্রপরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।
সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ঘন বেড়াজালে বাচ্চাদের ধরে নেওয়া হচ্ছে। তার পরে গঙ্গার খয়রা মাছ বলে ৩০০-৪০০ টাকা কিলোগ্রাম দরে তাদের বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে বাজারে। একটা চলতি নামও আছে তাদের— ‘ঝটকা মাছ’। কিন্তু তারা আদৌ ঝটকা বা খয়রা নয়। ইলিশের ছানা। এ ভাবেই প্রতিদিন কেজি কেজি ইলিশের বাচ্চা মেরে ফেলা হচ্ছে বলে রাজ্যের মৎস্যবিজ্ঞানীদের একাংশের অভিযোগ। এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন গবেষকেরা মনে করছেন, গঙ্গার ইলিশ বাঁচাতে ধীবরদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন সরকারের কড়া নজরদারি।
পৌষ থেকে বৈশাখ পর্যন্ত গঙ্গায় প্রচুর পরিমাণে ইলিশের চারা পাওয়া যায়। যা ‘ঝটকা’ মাছ নামে পরিচিত। মৎস্যবিজ্ঞানীরা বলছেন, এক শ্রেণির ধীবর ফেব্রুয়ারি থেকে বেহুন্দি বা ভেসাল নামে অত্যন্ত ছোট ফাঁসের জালে ওই ঝটকা অর্থাৎ ইলিশের চারা ধরে নিচ্ছেন। ফলে গঙ্গায় বেড়ে ওঠার কোনও সুযোগ পাচ্ছে না ইলিশছানারা। মৎস্যবিজ্ঞানীদের বক্তব্য, পরীক্ষামূলক ভাবে অন্তত একটা বছর নভেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত যদি ছোট ফাঁসের জাল নিষিদ্ধ করা যায়, তা হলেও গঙ্গায় প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে। সে-ক্ষেত্রে অবশ্য ওই নিষেধ-পর্বে সরকারি উদ্যোগে ধীবরদের বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করার কথাও বলছেন কেউ কেউ।
সাধারণত বর্ষার মরসুমে অনুকূল পরিবেশ পেলে সাগরমোহনা হয়ে ইলিশ ঢোকে গঙ্গায়। মিষ্টি জলে ডিম পেড়ে সমুদ্রে ফিরে যায় তারা। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে বিজ্ঞানীরা দেখছেন, ফিরে যাওয়ার পথে মোহনার কাছে ফের জালে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে ইলিশের একটা অংশ গঙ্গারই বিভিন্ন জায়গায় থেকে যাচ্ছে। যাদের গঙ্গার ‘রেসিডেন্সিয়াল পপুলেশন’ বা ‘আবাসিক ইলিশ’ বলেই চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। দেখা যাচ্ছে, পরবর্তী কালে তারা গঙ্গাতেই প্রজননে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। ডিম পাড়ছে এবং বাচ্চাও হচ্ছে। ধীবরদের জালে সেই ইলিশচারাই ধরা পড়ছে বলে জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক ও ইলিশ গবেষক অসীমকুমার নাথ জানান, এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে জেলেদের জালে প্রচুর ইলিশের চারা ধরা পড়েছে। যাদের ওজন ১০ থেকে ২৫ গ্রামের মধ্যে। যে-সব ইলিশ গঙ্গায় থেকে যায়, এরা তাদেরই ডিমের চারা। এই চারা বাঁচানো খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। বিষয়টি সরকারি স্তরেও জানিয়েছেন অসীমবাবু। তাঁর বক্তব্যে সুর মিলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় মৎস্য শিক্ষা সংস্থার অন্যতম বিজ্ঞানী বিজয়কালী মহাপাত্রের। তিনিও মনে করেন, গঙ্গায় ইলিশচারা
বাঁচানো জরুরি।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার নিশ্চিন্দাপুর থেকে হুগলির বলাগড় পর্যন্ত গঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় আবাসিক ইলিশদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। আর তাদেরই ছানারা প্রতিদিন ধরা পড়ছে শ্রীরামপুর, ব্যারাকপুর, ইছাপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায়। কোনও কোনও অঞ্চলে একটি ছোট নৌকায় ১২ কেজি পর্যন্ত চারা ধরা পড়েছে বলে জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা।
চারা ইলিশ যে ধরা হচ্ছে, তা মেনে নিয়েই রাজ্যের মৎস্য দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর সপ্তর্ষি বিশ্বাস বলেন, ‘‘আমরা মৎস্যজীবীদের বোঝানোর চেষ্টা করছি। অনেক বৈঠকও করা হয়েছে। একটা নির্দিষ্ট সময়ে মাছ ধরার বদলে তাঁদের জন্য বিকল্প কিছু জীবিকারও ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’