প্রতীকী ছবি।
এ নদীর ঘাটে গেলে সে যেন এখন একটাই গল্প বলে। তার পাড় ‘চুরি’র গল্প।
এক কথায় বলতে গেলে, বাঁকা নদী বর্ধমান শহরের ‘লাইফ লাইন’ (জীবনরেখা)। কিন্তু ঘটনা হল, বিগত কয়েক দশক ধরে অবহেলিত থাকায় বাঁকার পাড় ‘চুরি’ করে একের পরে এক বেআইনি নির্মাণ হয়েছে। যা ভাঙার ব্যাপারে বাম বা ডান—কোনও পক্ষই উৎসাহ দেখায়নি। অভিযোগ, বেআইনি নির্মাণকে বাঁচিয়ে বছরখানেক ধরে পাড় বাঁধিয়ে বাঁকা সংস্কার করছে বর্ধমান উন্নয়ন পর্ষদ (বিডিএ)।
বাঁকা নদীর পথ গলসি থেকে মন্তেশ্বর পর্যন্ত। সেই ১২৫ কিলোমিটারের মধ্যে বর্ধমান শহরের ভিতর দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার বাঁকা প্রবাহিত হয়েছে। প্রবীণ বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, এই নদী দিয়ে বর্ধমানের রাজাদের পূর্বপুরুষেরা নৌকা করে যাতায়াত করতেন। এমনকী, এই নদীকে ঘিরে শহরে ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রও গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সে সব এখন ইতিহাস। কাঞ্চননগর থেকে রায়নগর পর্যন্ত বাঁকার দু’পাড়ে অজস্র জায়গায় বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে। বাঁকা সংস্কার করতে গিয়ে সে অভিযোগের সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন বিডিএ-র নিযুক্ত ঠিকাদারেরা। তাঁদের কয়েকজনের কথায়, “বাঁকার পাড়ে থাকা বেআইনি নির্মাণ না সরিয়ে নদী সংস্কার করতে গিয়ে বারেবারে সমস্যায় পড়েছি। কাজের গতিও আসেনি।” যদিও এই সংস্কার নিয়ে নদী বিশেষজ্ঞদের ক্ষোভ রয়েছে। তাঁদের কথায়, “পাড়ে কাজ না করে শুধু নদীর মাঝে সংস্কার করলে মূল উদ্দেশ্যটাই ব্যাহত হয়।”
শুধু বাঁকার পাড় নয়, বর্ধমান শহর জুড়ে রয়েছে বেআইনি নির্মাণ। নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সরু গলির ভিতরেও গজিয়ে উঠেছে বহুতল! পুরসভার কর্তারাই জানাচ্ছেন, বেআইনি নির্মাণ নিয়ে পুরসভার বাস্তুকার বিভাগ নাজেহাল। প্রতি বছর ৫০০-৭৫০ বেআইনি নির্মাতাকে নোটিস ধরাতে হয়। তাদের অনেকেই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। তবুও বছরে দু’-একটি বাড়ি ভাঙা হয়! তবে বাঁকার পাড়ে বেআইনি বাড়ি ভাঙার কোনও সাম্প্রতিক নজির নেই বলে পুর-কর্তারা জানিয়েছেন।
বাঁকার পাড় ‘দখল’ শুরু হয়েছে ২০০৫ সাল নাগাদ। প্রথমে অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করে জায়গা দখল, ধীরে ধীরে স্থায়ী বাসস্থানের বন্দোবস্ত। অভিযোগ, এই ‘দখলদার’দের দেখে বাঁকা থেকে দূরে বাড়ি করা বাসিন্দারাও কিছু কিছু জায়গায় পাড় দখল করে নিতে শুরু করেছেন। ফলে, দিনে দিনে বাঁকার দু’পাড়ে অসংখ্য বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। নতুন করে বস্তি তৈরি হয়েছে। ভাতছালা, ইছলাবাদের মতো জায়গায় বাঁকা মারাত্মক সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। এমনকী, মাসখানেক আগে সেচ দফতর নদীর বদলে ‘বাঁকা নালা’র নামে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল। এই পরিস্থিতির জন্য পুরসভা এবং বিডিএ-র দিকে আঙুল তুলেছেন অনেক এলাকাবাসী।
পুর-কর্তাদের অনেকেই মানছেন, অতীতে বাঁকা নদী বর্ধমানের নগরজীবনের গৌরবময় অধ্যায় ছিল। কিন্তু তাকে পুরনো চেহারায় ফেরানোর পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে নদীর পাড়ের বেআইনি নির্মাণ। পুরপ্রধান স্বরূপ দত্ত বলেন, ‘‘আসলে নদীর পাড়ের জমি সেচ দফতরের। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে দখল হয়েছে। এক কথায় তাই সেগুলো ভাঙা যাচ্ছে না। তাঁর সংযোজন: ‘‘পরিকাঠামোগত সমস্যা থাকায় ইচ্ছে থাকলেও আমাদের পক্ষে প্রত্যাশিত মাত্রায় নজরদারিও করে ওঠা যাচ্ছে না।’’ পক্ষান্তরে, বিডিএ-র চেয়ারম্যান তথা বর্ধমানের বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “এই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইচ্ছায় বাঁকার সংস্কারের কাজ চলছে। দুই পাড়ের সৌন্দর্যায়ন করে বাঁকাকে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য উদ্যোগী হয়েছি। কাউকে উচ্ছেদ করলে কি এই উদ্যোগ সুষ্ঠু ভাবে শেষ করা যাবে!”
নাগরিকদের বড় অংশ ‘কর্তা’দের মনোভাবে হতাশ। তাঁদের উৎকণ্ঠা, ‘‘পাড় চুরি গিয়েছে। এ বার নদীর বুক ভরাট করেই না বাড়ি তোলে!’’