চিন্তায় আঁধার/২

কুসংস্কার রুখতে বাধা আসে প্রায়ই

প্রচার চলে। নানা কর্মসূচি হয়। তবু ডাইনি অপবাদে ঘরছাড়া করা, ভূতে ধরেছে বলে ওঝা ডেকে নির্যাতন, এমন ঘটনার কথা প্রায়ই শোনা যায়। শুধু কী সচেতনতা, শিক্ষার অভাবেই এমন হয়, না কি এর পিছনে রয়েছে অন্য সমীকরণ, প্রশাসনই বা কী বলছে— খোঁজ নিল আনন্দবাজার।মেমারি ২ ব্লকের এক গ্রামে বর্ষার রাতে মদের আসর বসেছিল। সেখানেই ‘ডাইনি’র খোঁজ পেয়ে যান মদ্যপরা। রাতেই একটি পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করা হয়। চলে বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট। এমনকি, ঘটনার প্রতিবাদ করায় আরও কয়েকজনকে গ্রাম ছাড়তে হয়। টানা তিন বছর গ্রামের বাইরে থাকেন ১৭ জন।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৩ জুলাই ২০১৮ ০৮:২০
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

বছরখানেক আগে জেলার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার শ’খানেক ‘মোড়ল’দের নিয়ে প্রশিক্ষণ শিবির করেছিল জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের কর্তারা গ্রামের ‘মাথা’দের বুঝিয়েছিলেন কুসংস্কার থেকে তাঁরা না বেরোলে গ্রামকেও বের করতে পারবেন না। সেখানে ডাইনি অপবাদ দেওয়া তো বটেই সাপে কাটলে ওঝার কাছে না নিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো নানা বিষয়েও সচেতন করা হয়। তারপরেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি।

Advertisement

মেমারি ২ ব্লকের এক গ্রামে বর্ষার রাতে মদের আসর বসেছিল। সেখানেই ‘ডাইনি’র খোঁজ পেয়ে যান মদ্যপরা। রাতেই একটি পরিবারকে গ্রাম ছাড়া করা হয়। চলে বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট। এমনকি, ঘটনার প্রতিবাদ করায় আরও কয়েকজনকে গ্রাম ছাড়তে হয়। টানা তিন বছর গ্রামের বাইরে থাকেন ১৭ জন।

সেই সময় ওই পরিবারের পাশে থাকায় গ্রামের ‘মাতব্বর’দের হুমকির মুখে পড়তে হয় ‘ভারত জাকা মাঝি পরগণা মহল’ নামে একটি সংগঠনের সদস্যদেরও। ওই সংগঠনের দাবি, তাঁদের সদস্যরা যাতে মেমারির ওই গ্রামে গিয়ে কুসংস্কার-বিরোধী প্রচার করতে না পারে, তার জন্য কয়েকজন অস্ত্র নিয়ে পাহারা দিত। মেমারি ছাড়া জেলার অন্যত্রও তাঁদের এমন ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে বলে ওই সংগঠনের দাবি।

Advertisement

তাঁরা জানান, জন্ম, মৃত্যু থেকে জীবনের নানা পর্যায়ে আদিবাসী সমাজ ‘মোড়ল’দের উপর নির্ভরশীল। এ জেলার মোট জনসংখ্যার ১০ থেকে ১২ শতাংশ আদিবাসী। তাঁরা মূলত বাস করেন মেমারি, আউশগ্রাম, জামালপুর, খণ্ডঘোষ, রায়না, ও ভাতারে। তাঁর মধ্যে মেরেকেটে ৪২ শতাংশ মানুষ সাক্ষর। ওই সংগঠনের অন্যতম নেতা উপেল মান্ডির দাবি, “আমাদের সমাজের মোড়লদের অধিকাংশই শিক্ষা থেকে অনেক দূরে রয়েছেন। তাঁদের শিক্ষিত করে তুলতে না পারলে কুসংস্কারের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিনই।’’ রবিবার কলকাতায় রাজ্য কমিটির বৈঠকে মোড়লদের শিক্ষিত করে তোলা থেকে অলচিকি ভাষার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনাও করেন তাঁরা। সংগঠনের এক নেতার কথায়, “আর্থিক ভাবে আদিবাসীরা আগের থেকে সাবলম্বী হয়েছেন। তবে সামাজিক সচেতনতায় এখনও পিছিয়ে রয়েছেন।’’ তাঁর অভিযোগ, ‘‘মোড়লদের বা তাঁদের অনুগামী মাতব্বরদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রে আইন মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে পারে না সরকার। আর ভোট ব্যাঙ্কের জন্য ওই সব মোড়লদের চটাতে চায় না রাজনৈতিক দলগুলি।’’

সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য সুরেন হেমব্রমের দাবি, “শাসক দলের উচিত এ রকম ঘটনার বিরোধীতা করা। কিন্তু তারা চুপ থাকার ফলেই মোড়লদের নির্যাতন বাড়ছে।’’ অনেকেই মনে করেন, এ ধরণের ঘটনা ঘটানোর আগে এলাকায় জনমত তৈরি করেন মোড়লেরা। শাসক দলের কর্মীরা প্রথমেই বিরোধিতা করলে বা প্রশাসনকে জানালে কোনও ঘটনাই ঘটে না। বিজেপির সাংগঠনিক সম্পাদক সন্দীপ নন্দীর কথায়, “বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা এ সব ঘটনায় মদত দেয়। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, তৃণমূল এর পিছনে রয়েছে।’’ যদিও এ সব মানতে নারাজ বিদায়ী সভাধিপতি দেবু টুডু। তাঁর কথায়, “সামাজিক ভাবে সচেতন করার জন্য মোড়লদের শিক্ষিত করে তোলা, প্রশিক্ষণ দেওয়া, ভাল কাজ করলে সংবর্ধনা দেওয়া হয়ে থাকে।’’

আদিবাসী সমাজের প্রথা নিয়ে গবেষণা করছেন বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। তিনি বলেন, “মাতব্বরদের বা মোড়লের কথা অমান্য করতে পারে এমন বাসিন্দা অথবা খুবই দরিদ্র ও অসহায় মহিলার সম্পত্তি হাতানোর জন্যেই ডাইন বা ভূতে ধরার গল্প ছড়ানো হয়। এখন শুধু আদিবাসী নয়, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজনেরও মধ্যেও কুসংস্কারের ছোঁয়া লাগছে। সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে।’’

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন