সেই আড্ডাটা আজ আর নেই...

প্রতিটি রক আড্ডার পাশে থাকত একটি চায়ের দোকান, আর দোকানির কাছে ‘চিত্রগুপ্তের’ খাতা। আসানসোলের বিখ্যাত এলাকা তখন হটন রোড।

Advertisement

অমল বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৮ ০১:১০
Share:

ইতিউতি এখনও দেখা যায় এই ছবি। আসানসোলের চিত্রা সিনেমা হলের সামনে। ছবি: শৈলেন সরকার

একটা সময় ছিল। ছোট্ট শহর আসানসোলের বাঙালিপ্রধান এলাকাগুলিতে বাড়ির সামনে বারান্দা থাকত। হটন রোড, এনএস রোড, আসানসোল গ্রাস ট্র্যাফিক রেল কলোনি, ডিপোপাড়া, ধাদকা, মুর্গাসোল প্রভৃতি এলাকায় অধিকাংশ বাড়ির সামনে থাকত বারান্দা। ছেলে ছোকরারা নাম দিয়েছিল ‘রক’। পশ্চিমবঙ্গের যে কোনও শহরে তখন রক-সভ্যতা প্রচণ্ড জনপ্রিয়।। রকের আড্ডা থেকেই তখন উঠে আসত কাফকা, লেনিন, মার্কস থেকে চারু মজুমদার। ক্রিকেট, ফুটবল, নাটক, লিটল ম্যগাজিন থেকে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভু মিত্র। উৎপল দত্তই বা বাদ থাকেন কী করে!

Advertisement

এবং প্রতিটি রক আড্ডার পাশে থাকত একটি চায়ের দোকান, আর দোকানির কাছে ‘চিত্রগুপ্তের’ খাতা। আসানসোলের বিখ্যাত এলাকা তখন হটন রোড। অনেক কারণেই বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল এই প্রাচীন রাস্তাটি। প্রথমত, বাহুবলীদের দাপট। টুনু বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামদা, মনুদা তখন ছিলেন হটন রোডের সর্বেসর্বা। অন্য দিকে নাটকে তখন তোলপাড় করে চলেছে ‘শিল্পীকোণ’ সংগঠন। ছোট খোকাদা ওরফে সুনীল ঘোষ নিয়মিত নাটক করছেন। সাহিত্য পত্রিকা করছেন একদল। রাজনীতিতে নকশাল বাড়ি আন্দোলন তখন তুঙ্গে, তার অন্যতম নেতা সহদেব মুখোপাধ্যায় এই হটন রোডে থাকতেন। শহরের উত্তরের ডিপোপাড়া ধাদকাও তখন ছিল রকবাজদের দখলে। রাজনীতি থেকে সাহিত্য সংস্কৃতির দুর্বার গাড়ি ছুটতে দেখা যেত শহরের দক্ষিণে নেতাজী সুভাষ রোডে। দেশপ্রাণ সঙ্ঘ সাহিত্য সংস্কৃতিতে এগিয়ে থাকত। শিকড় কিন্তু সব রকেই। মুর্গাসোল, উষাগ্রাম, শিমুলতলা রক থেকেই চালিয়ে যেত যাবতীয় কার্যকলাপ। সেই সময়ে আসানসোলের রাস্তায় দেখা যেত বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যানবাহন। ইস্কো, ইসিএল, সেনর‌্যালে গ্লাস ফ্যাক্টরি-র নাম লেখা গাড়ি কর্মচারীদের কর্মস্থলে নিয়ে যেত। ফলে শহরটির নাম হয়ে যায় ‘শিল্পনগরী’। মূলত আসানসোল কয়লা লোহা-রেলের শহর। এক সময় রেলের কর্মচারীরা নাটক, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকতেন।

এখন বাড়ির সামনে আর বারান্দা দেখা যায় না। সেখানে এখন এটিএম কিংবা মোবাইলের দোকান। রকবাজেরাও আর নেই। তবে কি এই শহরের সাহিত্য সংস্কৃতির বিলুপ্তি ঘটেছে? না, তা নয়। পরিবর্তিত স্রোতে হটন রোডে দীপুর দোকানে লেখক- কবি-নাট্যকারদের ক্ষণস্থায়ী আড্ডা হয়। মুর্গাসোল মোড়ে টিমটিম করে জ্বলছে আড্ডাবাজদের উপস্থিতি। ডিপোপাড়া ধাদকায় এখন ক্লাব তৈরি হয়েছে। আড্ডা আছে, তবে আলোচনার বিষয়স্তু পাল্টেছে। রাজনীতি, খেলাধুলো, সাহিত্য-সংস্কৃতি এই সব আড্ডায় জায়গা পায় না। নোটবন্দি, আধার, ভর্তুকি নিয়ে দু’দিন আড্ডাস্থল সরগরম হলেও তা সাময়িক।

Advertisement

আড্ডা কি তা হলে হারিয়ে যাচ্ছে? বাঙালির জীবন থেকে আড্ডা মুছে যাওয়া বোধহয় কোনও দিনই সম্ভব নয়। আড্ডার রকম বদলাতে পারে। কিন্তু, যেখানে বাঙালি, সেখানে আড্ডা থাকবেই। গ্রামগুলিতে আজও আড্ডাস্থলের খুব একটা রকমফের ঘটেনি। আসানসোল শহরের আশেপাশের গ্রামগুলিতে হরিবোলতলা, কালী মন্দির, দুর্গামন্দির চাতালে আজও যুবক-বৃদ্ধেরা বসে গল্পগুজব করেন। আসানসোল শহরের অনতি দূরে একদা বিখ্যাত সাইকেল কারখানা যেখানে গড়ে উঠেছিল, সেই অঞ্চলটির নাম পাঁচগাছিয়া। এর আশেপাশে প্রচুর গ্রাম। সে রকমই একটি গ্রাম মেটে কন্যাপুর। এই গ্রামে বিকেলবেলায় বৃদ্ধদের আড্ডা বসে হরিবোলতলায়। নুনি, সামডি, গৌরান্ডি, জামুড়িয়ার মতো এলাকায় একই ছবি। বরাকর, কুলটি, রূপনারায়ণপুর, ডিসেরগড়, নিয়ামতপুরও আড্ডা ভোলেনি।

শহর আসানসোলে এক দশক আগেও বৃদ্ধদের আড্ডা দেওয়ার একটা নির্দিষ্ট জায়গা ছিল পার্টি অফিস। পাড়ায় পাড়ায় পার্টি অফিস ছিল। আজ পার্টি অফিস থাকলেও সেই সব প্রবীণকে দেখা যায় না। যেমন হটন রোডের প্রবীণ লেখক চিত্ত দত্ত। বয়সের ভারে হাঁটাচলায় অসুবিধা। তাঁর কথায়, “কোথায় আড্ডা মারব? ঘরে টিভি আর সংবাদপত্রের সঙ্গেই সময় কাটাই।” একই কথা মুর্গাসোলের অবসরপ্রাপ্ত ইসিএল কর্মী তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের— “মাঝে মাঝে চাচার চায়ের দোকানে বসি। চিনি ছাড়া চা খাই, কিছুক্ষণ আড্ডা দিই।” নেতাজি সুভাষ রোডে প্রবীণদের আর আড্ডা মারতে দেখা যায় না। তবে রাহা লেন মোড়ে কুয়োতলায় এখনও সমান তালে আড্ডা চলে প্রবীণদের। পাশে চায়ের দোকান। এখানে আড্ডা দিতেন শহরের বিখ্যাত অভিনেতা রমাপতি চট্টোপাধ্যায়। তিনি নেই, তবু আড্ডা চলছে সমান তালে।

শহরে দু’তিনটি ভাল লাইব্রেরি আছে। আগে বই নিতে আসা বঙ্গসন্তানেরা ঘণ্টাখানেক আড্ডায় মাততেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গল্প, উপন্যাস, জীবনচরিতের যে বিশাল চাহিদা ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা আর নেই। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও পাঠাগারে এসে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটায়। বই পড়লেও সবই কেরিয়ার ভিত্তিক বা ম্যাগাজিন। আড্ডায় বাঙালি জীবনের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার ছিটেফোঁটাও এখন নেই আলোচনার বিষয়বস্তুতে। পরিবর্তনের ধাক্কায় মানুষ এখন ছুটছে ভবিষ্যতের রূপরেখায়। তবু শিল্পাঞ্চলের বহু জায়গায় এখনও আড্ডা জমে, তবে আ়ড্ডাস্থলে চায়ের কাপে তুফান আর ওঠে না। আলোচনার বিষয়বস্তুতে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

মায়াকোভস্কি, ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়েরা। শহরের ববীন্দ্রভবনের সামনে সুরেশের চায়ের দোকানে লেখক, নাট্যকার, সাংবাদিকদের মাঝেমাঝে দেখা যায়, চা বিক্রি হয়, কিন্তু তুফান আর ওঠে না।

সংশয় জাগে, অফিস, বাড়ি, সংসার, এতেই কি তা হলে আবদ্ধ জীবন? বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, এ সব কি হারিয়ে যেতে বসেছে জীবন থেকে? তবু আশা রাখি, ফিরে আসবে পুরনো দিনগুলো।

লেখক একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন