দু’দলের প্রার্থীই বহিরাগত। কিন্তু তার মধ্যে শাসক দলের প্রার্থী এলাকায় একেবারে নতুন। শুধু তাই নয়, তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে আগের বিধায়ককে সরিয়ে, যিনি স্থানীয় বাসিন্দা ছিলেন। অপর পক্ষের ক্ষেত্রে অবশ্য এই সমস্যা খানিকটা কম। তাদের প্রার্থী এলাকার লোক না হলেও এই কেন্দ্র থেকে আগে ভোটে লড়েছেন। তার উপরে আবার জোট হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে। তাই গলসি কেন্দ্রে এ বার তারাই সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করছে ফরওয়ার্ড ব্লক।
গলসি ১ ব্লকের ১১টি পঞ্চায়েত ও কাঁকসার চারটি পঞ্চায়েত এলাকা নিয়ে তৈরি এই গলসি বিধানসভা কেন্দ্র। পূর্বতন কাঁকসা কেন্দ্রের কাঁকসা, ত্রিলোকচন্দ্রপুর, বিদবিহার ও বনকাটি পঞ্চায়েত রয়েছে এই কেন্দ্রের মধ্যে। আমলাজোড়া, মলানদিঘি ও গোপালপুর— কাঁকসার বাকি এই তিন পঞ্চায়েত চলে যায় দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভার অন্তর্গত। ১৯৭৭ থেকে অবলুপ্তির আগে পর্যন্ত কাঁকসা বিধানসভায় জিতেছে সিপিএম। গলসি কেন্দ্রে আবার ১৯৬২ সালের পর থেকে বামেরা কখনও হারেনি।
সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরে নতুন গড়ে ২০১১ সালে গলসিতে প্রায় ১১ হাজার ভোটে জেতেন ফরওয়ার্ড ব্লকের প্রার্থী সুনীল মণ্ডল। কিন্তু কাঁকসা হাইস্কুলের শিক্ষক সুনীলবাবু আড়াই বছর পরে যোগ দেন তৃণমূলে। ২০১৪ সালে বর্ধমান পূর্ব লোকসভা আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হিসেবে জিতে সাংসদও হন তিনি। গলসি কেন্দ্রে উপ-নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী করে কাঁকসা হাইস্কুলেরই আর এক শিক্ষক গৌরচন্দ্র মণ্ডলকে। তিনি হারিয়ে দেন ফরওয়ার্ড ব্লকের নন্দলাল পণ্ডিতকে।
গৌরচন্দ্রবাবুকে এ বার আর দল প্রার্থী করেনি। তাঁর জায়গায় টিকিট পেয়েছেন জেলা পরিষদের মৎস্য কর্মাধ্যক্ষ, খণ্ডঘোষের বাসিন্দা অলোক মাজি। দলের খণ্ডঘোষ ব্লক সভাপতি অলোকবাবু গত বিধানসভা ভোটে নিজের এলাকায় প্রার্থী হয়ে সিপিএমের নবীন বাগের কাছে হেরেছিলেন। এ বার দল পাল্টে নবীনবাবু সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, খণ্ডঘোষে প্রার্থিপদ নিয়ে ক্ষোভ আটকাতেই অলোকবাবুকে প্রার্থী করে পাঠানো হয়েছে গলসিতে। কিন্তু গলসিতে আবার তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন দলের কর্মীদের একাংশ। নিজের এলাকায় পরাজিত প্রার্থীকে অন্যত্র টিকিট দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। জেতা সত্ত্বেও গৌরচন্দ্রবাবুকেই বা কেন এ বার টিকিট দেওয়া হল না, সে নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে। এক জেলা তৃণমূল নেতার অবশ্য দাবি, গত বার গৌরচন্দ্রবাবুকে প্রার্থী করায় এলাকায় দলের একটি পক্ষ অসন্তুষ্ট হয়েছিল। দলের স্থানীয় নানা গোষ্ঠীর মধ্যে কোন্দল বন্ধ করতেই বহিরাগত প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। প্রার্থী অলোকবাবু অবশ্য এ সব বিতর্কে ঢুকতে নারাজ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘দল প্রার্থী করেছে। মাথার উপরে দলীয় নেতৃত্ব রয়েছেন। আমি অন্য কিছু নিয়ে ভাবতে চাই না।’’
ফরওয়ার্ড ব্লক অবশ্য এ বারও প্রার্থী করেছে নন্দলালবাবুকেই। শক্তিগড়ের কাছে সোহারি গ্রামের প্রবীণ এই বাম নেতা দলের জেলা কমিটির পুরনো সদস্য। দলের যুব লিগ এবং অগ্রগামী কিসানসভার সঙ্গেও দীর্ঘদিন যুক্ত রয়েছেন। বর্ধমান ২ পঞ্চায়েত সমিতির কর্মাধ্যক্ষও ছিলেন। কিন্তু উপ-নির্বাচনে গলসিতে তাঁকে প্রার্থী করার পরে দলের স্থানীয় কর্মীদের একাংশ ‘বহিরাগত’ তকমা দিয়েছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল, স্থানীয় কেউ প্রার্থী হলেই ভাল হতো। শেষে অবশ্য দলের উঁচুতলার হস্তক্ষেপে সমস্যা মেটে। তবে এখন তিনি এলাকায় অনেকটাই পরিচিত মুখ। নন্দলালবাবু বলেন, ‘‘আগে কী হয়েছে, তা ভাবার সময় নেই। এখন আমাদের একটাই লক্ষ্য, একজোট হয়ে তৃণমূলকে হারানো। আমরা সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।’’
২০১৪ সালে উপ-নির্বাচনে গলসিতে তৃণমূল প্রায় আট হাজার ভোটে জিতলেও সে বছরই লোকসভা ভোটে এই কেন্দ্রে তৃণমূলের সঙ্গে সিপিএমের ব্যবধান ছিল হাজার দুয়েক ভোট। এই পরিসংখ্যানই কিছুটা অস্বস্তিতে রাখছে তৃণমূলকে। কারণ, এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে লড়াইয়ে নেমেছে বামেরা। লোকসভা ভোটে বারবার প্রার্থী বদলের পরেও কংগ্রেস এখানে ৭৬২২টি ভোট পেয়েছিল। সেই ভোট ফরওয়ার্ড ব্লকে বাক্সে যোগ হলে আশঙ্কার রয়েছে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা।
গত উপনির্বাচনে গলসিতে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন সুন্দরলাল পাসোয়ান। পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ৪৯৮ ভোট। এ বারও ফের তাঁকে এখানে প্রার্থী করেছে দল। তৃণমূল এবং বাম-কংগ্রেস জোটের লড়াইয়ের মাঝে জোর টক্কর দেওয়ার জন্য ময়দানে নেমে পড়েছেন তিনিও।
তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য গলসি কেন্দ্রে জেতা নিয়ে আশা ছাড়ছে না। দলের দুর্গাপুর জেলা শিল্পাঞ্চল সভাপতি উত্তম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘যে কোনও পরিস্থিতিতে গলসিতে আমাদের জয় নিশ্চিত।’’