বধূ-বেশে: নববিবাহিত দম্পতি। নিজস্ব চিত্র
ঘরেতে অভাব তো কী হয়েছে! পড়শির মেয়েকে বড় করে, লেখাপড়া শিখিয়ে, বিয়ে দিয়ে বাবার দায়িত্ব পালন করলেন আউশগ্রামের এক দিনমজুর।
প্রায় উনিশ বছর আগে আউশগ্রামের গোস্বামীখণ্ডের বাসিন্দা স্বপন দাস বৈরাগ্যের স্ত্রী সদ্যোজাত কন্যা সন্তানকে রেখে আত্মঘাতী হন। তেরো দিনের সেই দুধের শিশুকে ফেলে রেখে হঠাৎ বেপাত্তা হয়ে যান স্বপনও। বাড়িতে আর কেউ না থাকায় গ্রামবাসী সঙ্কটে পড়েন। মেয়েটির কী হবে, এ নিয়ে যখন সকলে চিন্তিত— তখনই এগিয়ে এসে স্বেচ্ছায় মেয়ের দায়িত্ব নিতে চান ওই গ্রামেরই দিনমজুর রামপদ লোহার। রামপদর কথায়, কোনও আইনি কচকচানিতে নয়। একেবারে মনের তাগিদ থেকেই ওর দেখাশোনার দায়িত্ব নিই। তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন স্ত্রীও। আশ্বিনের এক সকালে মেয়েটিকে কোলে তুলে নাম দিয়েছিলেন ‘শিউলি’। রবিবার বিয়ে হল সেই মেয়েরই।
নিজের সম্বল বলতে একফালি ভিটে আর দিনমজুরি। এলাকার বাসিন্দা কর্ণ পালের কথায়, “এক পুত্র সন্তান থাকলেও একদিনের জন্যেও কেউ বুঝতে পারেনি রামপদ মেয়েটির পালক পিতা। শিউলিকে বিয়ে দিয়ে সেই বাবার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করল রামপদ। গ্রামের মানুষ হিসাবে ওর জন্যে গর্ব হয়।’’ স্থানীয় রামনগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর শিউলির উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ বার পরীক্ষায় বসেনি সে। তবে বর জানান, শিউলির পড়াশোনায় বাধা দেবেন না। আগামী বছর স্ত্রী পরীক্ষা দেবেন।
রামপদ জানান, বেশ কিছু দিন ধরেই ছেলে দেখছিলেন তিনি। খুঁজতে খুঁজতে একদিন পেয়েও যান। মাস দু’য়েক আগে হাওড়ার সাঁকরাইলের দিব্যেন্দু মণ্ডলের সঙ্গে শিউলির বিয়ের ঠিক হয়। গ্রামবাসীরাও সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। রামনগর গ্রামের দেবদাস সরকার, পুবার গ্রামের শেখ আসগররা জানান, “মেয়েটির জন্ম থেকে সমস্ত কিছুই আমরা জানি। যাঁর নিজেরই দু’বেলা ঠিক মতো খাবার জুটতো না, তিনি বিবেকের তাড়নায় বড় দায়িত্ব নিয়েছিলেন। লেখাপড়া, নাচ-গান শেখানো মেয়ের কোনও কর্তব্যেই হেলাফেলা করেনি।’’ আসগর, দেবদাসবাবুরা অঞ্চলের প্রতিটি গ্রামেই সাহায্যের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিছু পৌঁছয় রামপদ-র হাতে।
পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, মেয়ের সম্পর্কে সব কিছু বলেকয়েই বিয়ে হয়েছে। পাত্র কিছু না নিলেও বাবা হিসাবে মেয়ে-জামাইকে কিছু দেওয়ার জন্য নিজের শেষ সম্বলও বন্ধক রেখে মেয়েকে একটি সোনার হার আর জামাইকে একটি আংটি দিতে চেয়েছিলেন রামপদ। তবে সময়ে টাকাটা না পাওয়ায় তা দেওয়া হয়নি। দ্বিরাগমনে তা দেবেন বলে আশা রামপদর। তবে সব মিলিয়ে শ’পাঁচেক মানুষ এ দিন পাত পেড়ে খেয়েছেন তাঁর মেয়ের বিয়েতে।
সোমবার সকালে ছিল কন্যা বিদায়ের পালা। শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার সময়ে চোখের জল বাঁধ মানছিল না শিউলির। একই অবস্থা ছিল রামপদ ও তাঁর স্ত্রীরও। তাঁদের একটাই প্রার্থনা, মেয়ে যেন সুখে থাকে।আশ্বিনে পাওয়া শিউলি-বিদায় রামপদর