বোনাসের দিনেই চাঁই খসে মৃত দুই

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে দু’জনেই কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। গন্তব্য, পাণ্ডবেশ্বর এরিয়ার খোট্টাডিহি কোলিয়ারি। রবিবার, ইসিএল বোনাস ঘোষণা করেছে।

Advertisement

নীলোৎপল রায়চৌধুরী

পাণ্ডবেশ্বর শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০১৮ ০১:৫৮
Share:

দুর্ঘটনার পরে আবাসনে জটলা পড়শিদের। নিজস্ব চিত্র

রাতে খাওয়াদাওয়া সেরে দু’জনেই কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। গন্তব্য, পাণ্ডবেশ্বর এরিয়ার খোট্টাডিহি কোলিয়ারি। রবিবার, ইসিএল বোনাস ঘোষণা করেছে। দু’জনেরই পরিকল্পনা ছিল, কয়েক দিনের মধ্যেই পরিবারের সকলকে নিয়ে পুজোর কেনাকাটা করার। কিন্তু রবিবার সকাল হতে না হতেই সব বদলে গেল। খোট্টাডিহি কোলিয়ারির খনিকর্মী আবাসনে তখন খবর, কয়লার চাঁই চাপা পড়ে মৃত্যু হয়েছে খনিকর্মী চন্দ্রশেখর গিরি (৪৫) ও কালেশ্বর মাহাতোর (৫৫)।

Advertisement

দু’জনের বাড়ির দূরত্ব কয়েকশো মিটার, একই আবাসন চত্বরে। কালেশ্বরবাবুর পরিবার থাকে ঝাড়়খণ্ডের জামুইয়ে। চন্দ্রশেখরবাবুর পরিবার এখানেই থাকে। ঘটনার কথা চাউর হতেই এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, পড়শিদের জটলা। কালেশ্বরবাবুর স্ত্রী কৌশলাদেবী বলেন, ‘‘আমার আর কিছুই বলার নেই।’’ খনিকর্মীরা জানান, এ দিনই পুজো বোনাসের কথা ঘোষণা করেছে সংস্থা। স্থানীয় বাসিন্দা, পেশায় খনিকর্মী লছমি সাতোয়ার, জগবন্ধু ঘোষ বলেন, ‘‘বোনাসের পরেই শুরু হয় কেনাকাটা। এমন আনন্দের সময়ে এই দুর্ঘটনা কিছুতেই মানতে পারছি না আমরা।’’ দু’জন খনিকর্মীর মৃত্যুতে তাল কেটেছে এলাকার পুজোরও। খোট্টাডিহি কোলিয়ারি সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির তরফে স্বপন শীল বলেন, ‘‘আনন্দের সময়ে এমন বিষাদের ঘটনা খুবই আকস্মিক। দু’জনের ছবি পুজো প্যান্ডেলে রেখে তাঁদের শ্রদ্ধা জানানো হবে।’’

তবে এমন শোকের মাঝেও শ্রমিক-নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। চন্দ্রশেখরবাবুর ছোট ছেলে গোলু গিরি বলেন, ‘‘ঘটনাটা কিছুতেই মানতে পারছি না। পোষ্য হিসেবে পরিবারের এক জনকে চাকরি দেওয়াটা কোনও সমাধান নয়। এমন ঘটনা যাতে বার বার না হয়, সে দিকে কর্তৃপক্ষ এ বার অন্তত নজর দিক।’’

Advertisement

শ্রমিক-নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কর্মীসংগঠনগুলিও। সংগঠনগুলির নেতৃত্ব জানান, চাঁই খসে দুর্ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগে ২০০৬-এ অণ্ডালের শ্যামসুন্দরপুর কোলিয়ারিতে ছ’জন, ১৯৯৬-এ সাতগ্রাম ইনক্লাইনে চার জন, ২০০৯-এ সাতগ্রাম প্রজেক্টে দু’জন, ২০১৭-য় শ্রীপুর কোলিয়ারি এসএসআই খনিতে দু’জনের মৃত্যু হয় একই ভাবে। কিন্তু অভিযোগ, প্রতি বারই দুর্ঘটনার পরে শ্রমিক-নিরাপত্তায় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান খনি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।

কিন্তু কেন ঘটে এমন ঘটনা? কেকেএসসি-র নেতা নরেন চক্রবর্তী, এইচএমএসের নেতা শিবনাথ ঘোষ, সিটু নেতা তুফান মণ্ডল-সহ অন্য শ্রমিক নেতৃত্বের মতে, খনিগর্ভে কয়লার উপরে পাথরের স্তরে যে ফাটল থাকে, তা বাইরে থেকে সামান্য অংশ দেখা যায়। ফলে ফাটল কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত বা কতটা গভীর, তা অনুমানের ভিত্তিতে কাজ করতে হয়। এ ক্ষেত্রে এই ‘চাল-ধস’ আটকাতে কয়লা কাটার পরে নিয়মিত পরীক্ষা করতে হয়। তবে চালে কয়লা থাকলে চাল ধসে পড়ার আগে আওয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু পাথর থাকলে কোনও পূর্ব লক্ষণ ছাড়াই কয়লা পড়তে পারে। ইসিএলের ধেমোমেন কোলিয়ারির ওভারম্যান তথা ওভারম্যান ও মাইনিং সর্দারদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ইনমোসার সোদপুর এরিয়ার সম্পাদক সঞ্জয় মাজি বলেন, “এমন বিপত্তি আটকাতে কয়লা বা পাথর কাটার পরে চালে গর্ত করে ‘সিমেন্ট ক্যাপসুল’ ভরতে হয়। তার পরে এর মধ্যে রড ঢোকাতে হয়। তার পরে বাইরে থেকে লোহার প্লেট ও নাট দিয়ে জালের সাহায্যে গোটা কাঠামোটি ধরে রাখতে হয়।’’ যদিও ইসিএলের সিএমডি-র কারিগরি সচিব নীলাদ্রি রায়ের বক্তব্য, ‘‘তদন্তে এমন কোনও ঘটনায় সংস্থার বিরুদ্ধে গাফিলতির প্রমাণ মেলেনি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন