সমস্যা শুরু হয়েছিল গোড়া থেকেই। পাণ্ডবেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রের নস্করবাঁধ প্রাথমিক স্কুলের বুথে প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়েছিলাম। ভোটের জিনিসপত্র বিলি ও গ্রহণ কেন্দ্র (ডিসিআরসি) ছিল দুর্গাপুর গভর্নমেন্ট কলেজে। সেখানে জায়গা বেশ কম। সংকীর্ণ জায়গায় ধুলোর উপরে চট পেতে কাগজপত্র বা ইভিএম পরীক্ষার ব্যবস্থা। জিনসিপত্র-সহ পাঁচটি বুথের কর্মীকে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি বাস। দুপুর ১টার মধ্যে আমাদের কাজ শেষ হয়ে গেলেও চড়া রোদে অপেক্ষা করতে হল আরও ঘণ্টা তিনেক। তার পরে ওঠা গেল বাসে।
বিকেল সাড়ে ৫টা নাগাদ বুথে পৌঁছেই নজরে পড়ল, জলের কোনও ব্যবস্থা নেই। সেক্টর অফিসারকে ফোন করায় তিনি আশ্বাস দিলেন। বুথের দেওয়ালে বুথ লেভেল অফিসারের (বিএলও) মোবাইল নম্বর লেখা থাকে। তাতে ফোন করতে এক পুরুষকন্ঠ বললেন, ‘‘আমি অফিসার নই। আমার বউ হতে পারেন। আমি কিছু জানি না।’’ ফোন কেটে দিলেন। অচেনা জায়গা। সন্ধে নেমে গিয়েছে। সঙ্গের শুকনো খাবারে রাত হয়তো কেটে যাবে। কিন্তু জল পাব কোথায়!
ঘণ্টা দেড়েক অপেক্ষা করার পরে জেলাশাসক ও মহকুমাশাসকের মোবাইল নম্বরে এসএমএস করলাম। জেলাশাসক উত্তরে জানালেন, এক জনকে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। ঘণ্টাখানেক পরে ব্লক অফিস থেকে এক জন এলেন বটে, কিন্তু প্রথমেই কৈফয়ত চেয়ে বসলেন, কেন সরাসরি জেলাশাসককে বার্তা পাঠিয়েছি! তার পরে গজগজ করতে-করতে বললেন, ‘‘এত বুথ। সব জায়গায় খোঁজ নিতে হচ্ছে। দেখি কী করা যায়।’’ শেষমেষ রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ সেক্টর অফিসার একটি ২০ লিটারের ড্রামে জল পাঠালেন। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
খাবারের ব্যাপারে অবশ্য কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করেননি। জলের বন্দোবস্ত হওয়ার পরে বাইরে বেরিয়ে স্থানীয় দু’এক জনের সাহায্যে দোকান থেকে রুটি-তড়কা জোগাড় হল। এর মধ্যে আবার অন্য সমস্যাও শুরু হয়ে গিয়েছে। সন্ধে থেকেই কিছু লোকজন আশপাশে ঘুরে বার্তা দিয়ে যাচ্ছিল, ‘এখানে কিন্তু একটিই দল’। রাত হতেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা গেট বন্ধ করে দিলেন। স্বস্তি পেলাম।
ঘুমোতে গিয়ে আবার সমস্যা। বলা হয়েছিল, ‘বেডরোল’ দেওয়া হবে। হয়নি। এবড়ো-খেবড়ো মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে পড়া গেল। কিন্তু গরমে বেশ কষ্ট হচ্ছিল। তার পরে রাত বাড়তেই একের পর এক উপদ্রব। প্রথমে পিঁপড়ে। তাদের তাড়াতে না তাড়াতেই হাজির বড় তেঁতুল বিছে! তাকে দূর করে ঘুমোতে গেলেও মাঝ রাতে ফিরে এল পিঁপড়ের দল। আর পারা গেল না। সাড়ে ৩টা নাগাদ সবাই উঠে পড়লাম। খানিক পরে সারা দিনের ভোটযুদ্ধের জন্য একে একে তৈরি হতে শুরু করলাম।
ভোট শুরু হল সকাল ৭টায়। ৯টা নাগাদ বিএলও এলেন। দুপুরে খাবারের কী ব্যবস্থা, সে প্রশ্ন তুলতেই তিনি সাফ জানালেন, তাঁকে কোনও বন্দোবস্ত করতে বলা হয়নি। শেষে আগের রাতের মতোই এলাকার কয়েক জনের সহযোগিতায় ভাত, ডাল, তরকারি জুটল। আগের রাতে যে জল দেওয়া হয়েছিল তা খাওয়ার উপযুক্ত ছিল না। দুর্গন্ধ, তার উপরে গরম হয়ে গিয়েছিল। পাড়ার লোকেরাই সারা দিন জলের জোগান দিলেন।
বুথে সকাল থেকে দেখলাম, মাত্র একটি দলের এজেন্ট। দুপুরের পর থেকে বেশ কয়েক জন ভোট দেওয়ার নামে এলেন। দেখেই সন্দেহ হচ্ছিল, উদ্দেশ্য ভাল নয়। আটকে দিলাম। এক জনকেও ভুয়ো ভোট দিতে দিইনি। এজেন্ট ব্যক্তিটি খানিকটা অসন্তুষ্ট হচ্ছিলেন। কিন্তু সিদ্ধান্তে অনড় ছিলাম। ভোট যখন মিটল, সন্ধে নেমে গিয়েছে। নিয়মমাফিক জিনিসপত্র গুছিয়ে যখন ডিসিআরসি-র পথ ধরলাম, শরীরে যেন আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই।