এক রাতেই জলের তলায়

দিন কয়েক আগে এক সকালে ঘণ্টা দুয়েকের বৃষ্টিতে শহরের রাস্তার হাল দেখে আশঙ্কটা তৈরি হয়েছিল। দুর্গাপুরে সেই আশঙ্কাই সত্যি হল রবিবার রাতে। টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জলের তলায় চলে গেল শহরের বিস্তীর্ণ অংশ। জলবন্দি হয়ে পড়লেন কয়েক হাজার মানুষ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ০১:৫৮
Share:

১) দুর্গাপুরের মেনগেট এলাকায় জলেই সফর। ২) জল ছাড়া হচ্ছে দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে।

দিন কয়েক আগে এক সকালে ঘণ্টা দুয়েকের বৃষ্টিতে শহরের রাস্তার হাল দেখে আশঙ্কটা তৈরি হয়েছিল। দুর্গাপুরে সেই আশঙ্কাই সত্যি হল রবিবার রাতে। টানা কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে জলের তলায় চলে গেল শহরের বিস্তীর্ণ অংশ। জলবন্দি হয়ে পড়লেন কয়েক হাজার মানুষ। শুধু দুর্গাপুর নয়, বৃষ্টিতে নাজেহাল শিল্পাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষজন। পাণ্ডবেশ্বর, রানিগঞ্জ থেকে আসানসোল শহর— কোথাও জলমগ্ন হয়ে পড়া, কোথাও ধসের জেরে নাজেহাল মানুষ।

Advertisement

ভাসল ঘরবাড়ি

রবিবার রাত সাড়ে ১১টা থেকে দুর্গাপুরের নানা এলাকায় জল জমতে শুরু করে। বেনাচিতির বিদ্যাসাগর পল্লিতে নর্দমা উপচে বাড়িতে জল ঢোকে। সিটি সেন্টারের আলাউদ্দিন বীথিতে পাঁচিল ভেঙে যায় একটি বাড়ির। সিটি সেন্টারে নর্দমা ও রাস্তা একাকার হয়ে যায়। ৫৪ ফুট লাগোয়া সারাদাপল্লিতে এক তলা বাড়ি প্রায় ডুবে যায়। অধিকাংশ একতলা বাড়িতে জল ঢুকে পড়ে। রাস্তা চলে যায় প্রায় ৫ ফুট নীচে। স্টিল পার্ক, বিধান পার্ক, অঙ্গদপুর নতুনপল্লি, তেঁতুলতলা কলোনি, সগড়ভাঙা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। প্রায় আড়াইশো বাসিন্দাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সগড়ভাঙা হাইস্কুলে। সোমবার সকালে প্রশাসনের দল ওষুধপত্র নিয়ে সেখানে যায়। রাতুড়িয়া-অঙ্গদপুর শিল্পতালুকের নানা কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। মাঝ রাতে ওয়ারিয়া পুলিশ ফাঁড়িতে জল ঢুকে যায়। লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের রাতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় স্কুলে। ডেয়ারি মোড়ে বেশ কিছু বাসিন্দা সোমবার সকালে বৃষ্টিতে ভিজে পথ অবরোধ শুরু করেন। তাঁদের অভিযোগ, বিপাকে পড়ে পুরসভা ও প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও সাহায্য মেলেনি। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে বিক্ষোভ থামে। ডিপিএল কলোনি লাগোয়া কালীপুর গ্রামে বেশ কিছু বাড়িতে জল ঢুকে যায়। এ ছাড়া মেনগেট, কাদা রোড এলাকায় অনেকে গৃহবন্দি হয়ে পড়েন। আসানসোলে গাডুই নদী উপচে জল আশপাশ জলমগ্ন হয়। শীদলা গ্রামে একটি পুকুরের পাড় ভেঙে লাগোয়া বেশ কিছু বাড়িতে জল ঢুকে যায়। কুলটির বিষ্ণুপ্রিয়া কলোনি ও কলেজ রোড লাগোয়া এলাকায় বাড়িতেও জল ঢুকে যায়। রানিগঞ্জে রহমতনগর, বামা ঘোষ এলাকায় কিছু বাড়ি জলমগ্ন হয়ে পড়ে। পরিবারগুলির হাতে খাবার তুলে দেওয়া হয় প্রশাসনের তরফে। কাঁকসার সিলামপুরে দামোদরের ঘাট লাগোয়া বালির বস্তার বাঁধ দামোদরের জলের তোড়ে যে কোনও সময় ভেঙে যেতে পারে বলে আশঙ্কায় রয়েছে ব্লক প্রশাসন। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে সন্ধ্যার পরে বাসিন্দাদের স্থানীয় সিলামপুর হাইস্কুলে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে জানান বিডিও অরবিন্দ বিশ্বাস। কাঁকসার বিরুডিহা, হাজরাবেড়া, কুনুরের জলে বুদবুদের দেবশালার আমানিডাঙা ও বাবলাবুনি, কাঁকোড়া, রাইকোনা, পানাগড়ের বেশ কিছু এলাকায় জল জমে যায়।

Advertisement

বন্ধ রাস্তা-সেতু

রাস্তায় জলে জমে যাওয়ার ফলে যাতায়াতের অসুবিধাও শুরু হয় শহরে। বৃষ্টিতে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্তও হয়। বেনাচিতির শ্রীনগরপল্লির রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জাতীয় সড়কে মুচিপাড়া, মেনগেট, ভিড়িঙ্গি, গাঁধী মোড়-সহ বেশ কিছু জায়গায় জল জমে যায়। তার জেরে যান চলাচল স্তব্ধ হয়ে যায়। পরে ধীরে-ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে। হ্যানিম্যান সরণিতে কিছু দিন আগে উদ্বোধন হওয়া তামলার ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সারাদাপল্লিতে রাস্তা প্রায় ৫ ফুট জলের তলায় চলে যায়। অন্ডালের রেল টানেল এ দিন প্রায় সকাল ১০টা পর্যন্ত জলে ভরে থাকায় চলাচল বন্ধ থাকে। ঘুরপথে যাতায়াত করতে হয়। অন্ডাল স্টেশনে ঝুঁকি নিয়ে পড়ুয়া-সহ অনেকে লাইন পারাপার করেন। জল জমে যাওয়ায় উখরা-গাইঘাটা রাস্তায় যানজট হয়। অন্ডালের বিডিও মানস পাণ্ডে জানান, সিঙ্গারন নদীর জল উপচে শ্রীরামপুর থেকে দুর্গাপুর যাওয়ার রাস্তায় প্রায় সারাদিন যান চলাচল করেনি।

৪) জলমগ্ন দুর্গাপুরের অর্জুনপুরের নতুনপল্লি। ৩) রানিগঞ্জের বল্লভপুরে উঠোনে ধস।

ধসে আতঙ্ক

রানিগঞ্জে বল্লভপুরের রঘুনাথচকে লোকালয়ের কাছে একটি মাঠে বেশ কিছুটা এলাকা জুড়ে গর্ত তৈরি হয়। এলাকাবাসীর বক্তব্য, আগে এখানে ভূগর্ভস্থ খনি ছিল। কয়লা কেটে ঠিক ভাবে বালি ভরাট না করায় এমন ঘটেছে। পুলিশ ওই এলাকা ঘিরে দিয়েছে। জামুড়িয়ার পরাশিয়া কুলডাঙায় একটি বাড়ির উঠোনে প্রায় ১০ ফুট গর্ত তৈরি হয়। কোলিয়ারির এজেন্ট এস কুমার দুই আধিকারিককে নিয়ে সেখানে যান। বাসিন্দারা পুনর্বাসনের দাবি তোলেন। তাঁরা জানান, এই এলাকা বসবাসের পক্ষে বিপজ্জনক। বছরখানেক আগে সামান্য দূরেই একটি বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়েছিল। এজেন্ট বিষয়টি নিষ্পত্তির আশ্বাস দেন। অন্ডালের শ্যামসুন্দরপুর ইনক্লাইনে কয়লা তোলার ব্লেটের রাস্তার উপরিভাগ ধসে যায়। কর্তৃপক্ষ জানান, দ্রুত সারানোর ব্যবস্থা হচ্ছে।

নিকাশিতে ক্ষোভ

বিপদগ্রস্ত এলাকাবাসীর পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে পুরসভার অনেক মেয়র পারিষদ থেকে কাউন্সিলর, শাসকদলের নেতাদের তৎপরতা দেখা গেলেও দুর্গাপুরে জলমগ্ন প্রায় ১০টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা নিকাশি ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পুরসভার বিরুদ্ধে অপরিকল্পিত নির্মাণ, মান্ধাতা আমলের নিকাশি, প্লাস্টিক বন্ধে জোরদার অভিযানের অভাবের অভিযোগ উঠেছে। শহরের নিকাশি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ তামলা নালার পরিসর কয়েক বছরে অবৈধ নির্মাণের জেরে কমে গিয়েছে বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। তাতে আশপাশ জলমগ্ন হয়ে পড়ছে। অবৈধ নির্মাণ ভাঙতে প্রশাসন তেমন উদ্যোগী হয়নি বলে অভিযোগ।

কর্তারা বলেন

দুর্গাপুর পুরসভার ডেপুটি মেয়র অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের খাবারের ব্যবস্থা হয়েছে। মহকুমাশাসক (দুর্গাপুর) শঙ্খ সাঁতরা জানান, তামলায় আগেই এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে এলাকায় গিয়ে অবৈধ নির্মাণ চিহ্নিত করে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। অবৈধ নির্মাণ ভেঙে ফেলা হবে বলে তাঁর আশ্বাস। আবার সিটি সেন্টার এলাকার বিস্তীর্ণ অংশের নিকাশির জল গিয়ে পড়েছে ভগৎ সিংহ মোড় লাগোয়া ডিএসপি-র প্রধান নালায়। পুরসভার অভিযোগ, ডিএসপি সেই নালার উপযুক্ত সংস্কার না করায় সিটি সেন্টার থেকে জল নামতে সময় বেশি লাগছে। ফলে, এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ডুবে যাচ্ছে কবিগুরু প্রধান সড়ক। ডিএসপি কর্তৃপক্ষ যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেন। প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, দুর্গাপুর ব্যারাজ থেকে সকাল ১১টায় প্রায় ৯০ হাজার কিউসেক, বিকেল ৫টা নাগাদ প্রায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার ও রাত ৮টা নাগাদ প্রায় ১ লক্ষ ১৮ হাজার কিউসেক হারে জল ছাড়ে ডিভিসি। জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন জানান, নতুন করে বৃষ্টির কোনও খবর মেলেনি। রাতে এই হার কমে যাবে বলে আশা তাঁর।

— সোমবার ছবিগুলি তুলেছেন বিকাশ মশান, ওমপ্রকাশ সিংহ ও বিশ্বনাথ মশান।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement