রাজ কলেজে দুর্নীতি পেল তদন্ত-দল

সাসপেন্ডই হলেন সেই তারকেশ্বর

পূর্ব বর্ধমান জেলাশাসকের ঘরে চলা বৈঠকে ওই রিপোর্ট পেশের পরেই রাজ কলেজের প্রাক্তন টিচার-ইন-চার্জ তথা কলেজের বিবিএ-বিসিএ বিভাগের প্রধান তারকেশ্বর মণ্ডলকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৩০
Share:

তারকেশ্বর মণ্ডল। ফাইল চিত্র

স্রেফ নমুনা-পরীক্ষাতেই ৫০-৬০ লক্ষ টাকা নয়ছয় করার হিসেব মিলেছে! বিভিন্ন লেনদেনের হিসেবের নথি কলেজে পাওয়া যায়নি, এমনকী বিবিএ-বিসিএ বিভাগেও ঢুকতে পারেনি তদন্তকারী দল। পরিস্থিতি এতটাই ‘কঠিন’, যে তিনি কলেজে থাকলে আর্থিক-দুর্নীতি নিয়ে তদন্তই করা যাবে না।

Advertisement

উপরে যে কথাগুলি লেখা আছে, ঠিক সেগুলিরই উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার বর্ধমানের রাজ কলজের পরিচালন সমিতির সভায় রিপোর্ট জমা দেন কলেজের দুর্নীতি-কাণ্ডের তদন্তকারী দলের প্রধান, ট্রেজারি অফিসার (১) বন্ধু সাহা। পূর্ব বর্ধমান জেলাশাসকের ঘরে চলা বৈঠকে ওই রিপোর্ট পেশের পরেই রাজ কলেজের প্রাক্তন টিচার-ইন-চার্জ তথা কলেজের বিবিএ-বিসিএ বিভাগের প্রধান তারকেশ্বর মণ্ডলকে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বৈঠক শেষে জেলাশাসক তথা রাজ কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, “বিভাগীয় তদন্ত তো বটেই, অডিট রিপোর্টেও টিআইসি থাকাকালীন তারকেশ্বরবাবু সরকারি টাকা নয়ছয় করেছেন বলে জানা গিয়েছে। সে জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করার পাশাপাশি এফআইআর করার জন্যেও কলেজের অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’ অধ্যক্ষ নিরঞ্জন মণ্ডল বলেন, “যা বলার জেলাশাসক বলেছেন। আমি এ টুকু বলতে পারি, যা হবে নিয়ম মেনেই হবে।” বুধবার রাতে ইন্দ্রকাননে তাঁর বাড়ির সামনে ছ’টি মোটর বাইকে জনা পরেনো যুবক গিয়ে ‘হুমকি’ দিয়ে এসেছেও বলে পুলিশে অভিযোগ করেছেন নিরঞ্জনবাবু। এ দিন অধ্যক্ষ পুলিশের পাহারায় পরিচালন সমিতির বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন। তারকেশ্বরবাবু অবশ্য বলেন, “আমি এমন কিছু করিনি, যার জন্য আমাকে সাসপেন্ড হতে হবে। চিঠি পাওয়ার পরেই এ বিষয়ে কথা বলব।’’

Advertisement

নানা নালিশ

•২০১৩ সালে বিবিএ-বিসিএ বিভাগের দায়িত্বে থাকাকালীন এক শিক্ষিকাকে মারধর ও শ্লীলতাহানি। গ্রেফতারও হন তারকেশ্বর।

• কলেজে বহিরাগত যুবকদের দাপাদাপিতে মদত।

• কলেজের দায়িত্বে থাকার সময়ে বর্তমান অধ্যক্ষকে কাজে যোগ দিতে বাধা, অভব্য আচরণ।

• ২০১৬ সালে তারকেশ্বরের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রীকে চিঠি জনা প়়ঞ্চাশ শিক্ষক-শিক্ষিকার।

• এক শিক্ষিকাকে কলেজের ঘরে আটকে নিগ্রহে মদত।

•শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বেও নাম জড়িয়েছে। তাঁকে চড় মারার অভিযোগ ওঠে এক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে।

কয়েক দিন আগেই, স্মারকলিপি দেওয়ার নাম করে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ পরিচালিত ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সুরোজ ঘোষের নেতৃত্বে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী নিরঞ্জনবাবু-সহ কয়েক জন শিক্ষকের সঙ্গে অশালীন আচরণ করে বলে অভিযোগ ওঠে। নিরঞ্জনবাবু বর্ধমান থানায় লিখিত ভাবে জানান, তারকেশ্বরবাবুর উস্কানিতেই পড়ুয়ারা ওই আচরণ করেছেন। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে বর্ধমান থানা নির্দিষ্ট ধারায় মামলা শুরু করে। তারকেশ্বরবাবু আগাম জামিনের আবেদন এ দিন মঞ্জুর করেছে বর্ধমান আদালত।

কলেজ সূত্রে জানা যাচ্ছে, ২০১৩ সালের নভেম্বরে রাজ কলেজের টিচার-ইন-চার্জ হন বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক তারকেশ্বর মণ্ডল। প্রায় তিন বছর কলেজ পরিচালনার পরে তাঁরই ‘ঘনিষ্ঠ’ শিক্ষকদের একাংশ তাঁকে ‘তোলাবাজ’ আখ্যা দিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠান। ওই চিঠির ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষা দফতর তদন্ত শুরু করতেই গত বছরের ১০ জুন তারকেশ্বরবাবুকে টিচার-ইন-চার্জের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ওই বছর ২৩ ডিসেম্বর স্থায়ী অধ্যক্ষ হয়ে কলেজে যোগ দেন হাটগোবিন্দপুর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত কলেজের টিআইসি নিরঞ্জন মণ্ডল। তিনি দায়িত্ব নিয়েই দেখেন, ক্যাশ বই-সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নথির হদিস নেই। অনেক আর্থিক লেনদেনেরই কোনও হিসেব নেই। তিনি পরিচালন সমিতিকে জানান, তারকেশ্বরবাবুর আমলের কোনও হিসেব মিলছে না। অডিটরেরা নানা নথি চাইলেও তা দেওয়া যাচ্ছে না।

এই অবস্থায় কলেজে আর্থিক লেনদেন করা অসম্ভব ব্যাপার। ওই আবেদনের প্রেক্ষিতে পরিচালন সমিতি জেলার ট্রেজারি অফিসার (১), মহকুমাশাসক (বর্ধমান উত্তর), সরকারি প্রতিনিধি শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় সহ পাঁচ জনের একটি কমিটি গঠন করেন।

প্রায় এক বছর পরে সেই তদন্তের রিপোর্ট দিতে গিয়ে তদন্তকারীরা দাবি করেছেন, ‘আর্থিক তদন্ত করতে গিয়ে বারবার বাধা পেতে হয়েছে। বলতে গেলে, কোনও গুরুত্বপূর্ণ নথিই হাতে মেলেনি। স্রেফ নমুনা-পরীক্ষাতেই ৫০-৬০ লক্ষ টাকার গরমিল পাওয়া গিয়েছে। অজস্র ভুয়ো বিল মিলেছে। বারবার চেয়েও বিবিএ-বিসিএ বিভাগ থেকে কোনও নথি আমাদের হাতে আসেনি। আমরা ওই বিভাগে ঢুকতেও পারিনি। আমাদের ধারণা, বড় রকমের আর্থিক কেলেঙ্কারি রয়েছে। সে জন্য কোনও চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্সি ফার্মকে দিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করা হোক।’

এর পরেই পরিচালন সমিতির সদস্যেরা তারকেশ্বরবাবুকে সাসপেন্ড করে তাঁর বিরুদ্ধে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে এফআইআর করার সিদ্ধান্ত নেন। এ দিন পরিচালন সমিতির বৈঠকে ঠিক হয়েছে, মহকুমাশাসককে (বর্ধমান উত্তর) সামনে রেখে কয়েক জন শিক্ষককে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। কলেজে নিয়মভঙ্গ হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখে দরকারে ব্যবস্থা নেবে ওই কমিটি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন