স্কুলের শিক্ষক এবং অশিক্ষক কর্মচারীদের থাকার জন্য প্রধান শিক্ষকের নামে আটটি আবাসন বরাদ্দ করে ডিপিএল। কিন্তু সেই আবাসনের ভাড়া দেওয়া তো দূর, বরং ওই শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীরা সেখানে ভাড়া বসিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। পরে বিষয়টি ডিপিএল কর্তাদের নজরে আসায় দুর্গাপুর প্রজেক্ট টাউনশিপ বয়েজ হাইস্কুলের ওই প্রধান শিক্ষকের কাছে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আবাসন ভাড়া বাবদ বকেয়া ৯ লক্ষ টাকা দাবি করা হয়। ওই বছরেরই জুলাইয়ে প্রধান শিক্ষক রমাপ্রসাদ কোনার অবসর নেন। কিন্তু ভাড়া বাবদ বকেয়া টাকা ডিপিএলকে না দেওয়ায় ওই স্কুলের প্রশাসক তথা দুর্গাপুরের সহকারী স্কুল পরিদর্শক সত্যব্রত চৌধুরী দুর্গাপুরের কোকওভেন থানায় রমাপ্রসাদবাবুর বিরুদ্ধে গত মাসে একটি অভিযোগ দায়ের করেন। একই সঙ্গে ওই প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের নামে নানা অনিয়মের অভিযোগ পেয়ে তদন্ত শুরু করে জেলা সর্বশিক্ষা মিশন।
সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, তদন্তে প্রচুর অসঙ্গতি পাওয়া যায়। শিক্ষককে শো-কজও করা হয়। সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা প্রকল্প আধিকারিক ভাস্কর পাল বলেন, “ওই স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একটি ঘটনায় এফআইআর করা হয়েছে। এ ছাড়াও আমরা সর্বশিক্ষা মিশন প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগে তদন্ত করেছিলাম। সেখানেও অনেক অসঙ্গতি মিলেছে। সে কারণেই শো-কজ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর উত্তরে আমরা সন্তুষ্ট হইনি। ওই প্রধান শিক্ষককে সমস্ত নথি নিয়ে সশরীরে আসতে বলা হয়েছে।” যদিও ওই শিক্ষক রমাপ্রসাদ কোনারের দাবি, চক্রান্ত করে তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সর্বশিক্ষা মিশন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ২০০৩ সালের ২৫ এপ্রিল ডিপিএল ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের নামে ৮টি আবাসন দেয়। আবাসনগুলিতে ৫ জন সহ-শিক্ষক, ২জন চতুর্থ শ্রেণি কর্মী ও একজন গ্রন্থাগারিক থাকতেন। কিন্তু এর জন্য তাঁরা ডিপিএলকে ভাড়া তো দিতেনই না, উল্টে ওই আবাসনে ভাড়া বসিয়েছিলেন। পরে বিষয়টি নজরে আসায় সংস্থার ডেপুটি চিফ পার্সোনাল অফিসার গত বছরের ১২ এপ্রিল চিঠি পাঠান। চিঠিতে দাবি করা হয়, ২০০৩ থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮টি আবাসনের ভাড়া বাবদ বকেয়া রয়েছে ৯ লক্ষ ২২ হাজার ৬৪৭ টাকা। কিন্তু ওই টাকা শোধ না করেই প্রধান শিক্ষক রমাপ্রসাদ কোনার অবসর নেন। দুর্গাপুরের সহকারী স্কুল পরিদর্শক তথা ওই স্কুলের প্রশাসক সত্যব্রত চৌধুরীর নজরেও আসে যে ওই আবাসনগুলি যাঁদের নামে তাঁরা থাকেন না, কিন্তু ভাড়া বসিয়ে আয় করছেন। এরপরেই জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ওই প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোকওভেন থানায় এফআইআর করেন সত্যব্রতবাবু।
সর্বশিক্ষা মিশনের চার সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, একাধিক উন্নয়ন প্রকল্পে স্কুলের নথিতে কোনও ভাউচার নেই। অথচ সেই সব প্রকল্পের ‘ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট’ জমা দিয়েছেন প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধান শিক্ষকের কার্যকালের মধ্যে ১৫ লক্ষ ৪২ হাজার ৫০০ টাকার কোনও হিসাব পায়নি তদন্তকারী দল। যার মধ্যে ২০০৩-০৪ আর্থিক বর্ষে অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষের জন্য দেড় লক্ষ টাকা পেয়েছিল স্কুল। তার হিসেব জমা পড়ে গেলেও ওই শ্রেণিকক্ষ দেখতে পায়নি তদন্তকারী দল। তেমনি ২০০৪-০৫ আর্থিক বছরে শ্রেণিকক্ষ সংস্কারের জন্য ৪৫ হাজার টাকা পেলেও তার কোনও হদিস পায়নি তদন্তকারী দল। ওই দলের এক সদস্য বলেন, “ডিপিএল টাকা চেয়ে চিঠি না পাঠালে আমরা তো জানতেই পারতাম না স্কুলে এত দুর্নীতি রয়েছে।” সর্বশিক্ষা মিশনের শো-কজের জবাবে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, অবসর নেওয়ার আগে প্রশাসককে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা নিয়ে অডিটও হয়েছে। তা ছাড়া প্রশাকই তাঁকে এনওসি দিয়েছেন বলেও তাঁর দাবি। ওই শিক্ষকের আরও দাবি, ২০১২ সালের ২৫ অগস্ট দুষ্কৃতী হামলায় স্কুলের বেশ কিছু নথিপত্র চুরি হয়ে যায়। থানায় অভিযোগও করা হয়েছিল।” ভাস্করবাবুর অবশ্য জবাব দেখে বলেন, “আর কিছু চুরি গেল না শুধুমাত্র নথি নিয়ে গেল দুষ্কৃতীরা! আর চুরি হওয়ার দু’মাস পরে অভিযোগ হয়েছে। আমরা শোকজের জবাবে সন্তুষ্ট নই।” যদিও অভিযুক্ত রমাপ্রসাদবাবুর দাবি, ‘‘আমার কাছে সমস্ত নথি রয়েছে। তারপরেও জোর করে, চক্রান্ত করে আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। এই ধরণের মিথ্যা অভিযোগে আমার সম্মানহানি হচ্ছে।”