অলিগলিতে কোচিংয়ে ভিড়, চিন্তায় শিক্ষকেরা

গলি থেকে তস্য গলি, কোনও বাড়ির একতলা জুড়ে আবার কোথাও ছাদের দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে দেদার চলছে কোচিং ক্লাস। আর এই সকাল-সন্ধ্যা কোচিংয়ের ঠেলায় স্কুলমুখো হচ্ছে না বহু পড়ুয়াই। বর্ধমান শহরের একাধিক নামী স্কুলের শিক্ষকেরা চিন্তিত যে এত কিছুর পরেও মাধ্যমিকের কৃতী তালিকায় ৪৭ জনের মধ্যে এ শহরের এক জনও নেই।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০১৫ ০০:৩২
Share:

কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপনে ঢেকেছে শহর। ছবি: উদিত সিংহ।

গলি থেকে তস্য গলি, কোনও বাড়ির একতলা জুড়ে আবার কোথাও ছাদের দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে দেদার চলছে কোচিং ক্লাস। আর এই সকাল-সন্ধ্যা কোচিংয়ের ঠেলায় স্কুলমুখো হচ্ছে না বহু পড়ুয়াই। বর্ধমান শহরের একাধিক নামী স্কুলের শিক্ষকেরা চিন্তিত যে এত কিছুর পরেও মাধ্যমিকের কৃতী তালিকায় ৪৭ জনের মধ্যে এ শহরের এক জনও নেই।

Advertisement

মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ এ বছর জেলা ভিত্তিক শতাংশের হিসেবে যে পাশের হারের তালিকা বের করেছে সেখানেও প্রথম আটটি জেলার মধ্যে বর্ধমানের ঠাঁই হয়নি। শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও দাবি, আগে এ রকম কখনও হয়নি। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে এই ফলাফলের কারণ নিয়ে। শিক্ষকদের দাবি, দ্রুত পিছিয়ে পড়ার কারণ খুঁজে বের করতে না পারলে এ শহরের শিক্ষার ভবিষ্যতে গভীর সঙ্কট তৈরি হবে। পিছনের সারির পড়ুয়াদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বাড়বে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বর্ধমানের বেশ কয়েকজন শিক্ষাবিদ বলেন, “কয়েকটি নামী স্কুলে ১০০ শতাংশ পড়ুয়া পাশ করেছে ঠিকই, কিন্তু শহরের সব স্কুলের ছবি কী একই? নাহলে আমরা এগোচ্ছি কোথায়?’’ তাঁদের দাবি, ‘‘পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের সামনের সারিতে আনা যাচ্ছে না বলেই মাঝারি মানের ফল হচ্ছে।”

শহরের বেশ কয়েকটা স্কুলের আশপাশে ঘুরলেই বোঝা যায়, ব্যাঙের ছাতার মতো কোচিং সেন্টার গজিয়ে উঠেছে। স্কুলের দেওয়াল থেকে লাগোয়া বিদ্যুতের খুঁটি, গাছ থেকে নির্মীয়মাণ বাড়ির আলসে— একের পর এক কোচিং সেন্টারের নামের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গিয়েছে। নানা ‘দাদা’র নাম দিয়ে বিজ্ঞাপনের নীচে বড় বড় করে ফোন নম্বর দেওয়া রয়েছে। শহরের এক প্রবীণ, বিসি রোডের বাসিন্দা অনন্ত রায় তো জেলাশাসকের দফতরের সামনে বলেই ফেললেন, ‘‘বছর খানেক আগেও শহরের বিভিন্ন প্রান্তে জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন থাকত। এখন একই কায়দাতে ঝুলছে কোচিং সেন্টারের বিজ্ঞাপন। শিক্ষকমহল থেকে ছাত্রদের একাংশ বিভ্রান্ত হচ্ছে।’’ শহরের এক নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকাও বলেন, ‘‘স্কুলে এসেই আমার প্রথম কাজ ছিল ভবন লাগোয়া বিদ্যুতের খুঁটি, টেলিফোনের খুঁটি থেকে কোচিং সেন্টারের ফ্লেক্সগুলো ছিঁড়ে ফেলা। তবে পরের দিন আবার ফ্লেক্স লাগিয়ে চলে যেতেন কোচিং সেন্টারের কর্মীরা। এখন হাল ছেড়ে দিয়েছি।” আর এক প্রধান শিক্ষকের কথায়, ‘‘কোচিং সেন্টারের ছেলেরা স্কুলে ঢুকে প্রচারপত্র বিলি করত। সেটা কোনও রকমে আটকানো গিয়েছে। তবে ভর্তির সময় স্কুলের বাইরে প্রচারপত্র দেওয়া চলে।”

Advertisement

স্কুল আর কোচিংয়ের দু’ধরনের লেখাপড়ায় পড়ুয়ারা যে বিভ্রান্ত হচ্ছে তা বোঝা যায় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথায়। বর্ধমানের বিদ্যার্থী বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা কৃষ্ণা মুখোপাধ্যায় বলেন, “স্কুলের শিক্ষকেরা এক রকম পদ্ধতিতে পড়াচ্ছেন। আর কোচিংয়ে গিয়ে পড়ুয়ারা অন্য পদ্ধতিতে শিখছে। ফলে পড়ুয়াদের ‘স্যান্ডুউইচ’য়ের দশা হচ্ছে।” শহরের ৩০টা মাধ্যমিক স্তরের বিদ্যালয়ের বেশিরভাগ প্রধান শিক্ষক ও শিক্ষিকাদেরও দাবি, ‘‘কোচিং সেন্টারের জন্য একাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা তো বটেই, অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির পড়ুয়ারাও দেরি করে স্কুলে আসছে। নয় তো সপ্তাহে চার দিন আসছেই না। জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর দেয়, কোচিং থাকায় আসতে পারেনি। অভিভাবকদের বুঝিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না।”

যদিও অভিভাবকদের পাল্টা দাবি, স্কুলে পড়ানো হয় না বলেই কোচিংয়ে পাঠাতে হয়। স্কুলের সময়ে কোচিং সেন্টারগুলির সামনে গেলে দেখা যায়, রোদে-গরমে ছাতা নিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন অভিভাবকেরা। খোসবাগানে এক কোচিং সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অনিমা রায়, অনিন্দিতা সেনশর্মা নামে অভিভাবকরা বলেন, “স্কুলে শিক্ষকরা পড়ালে কী আর এই গরমে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!” তাঁদের দাবি, এই সব কোচিং সেন্টারে ল্যাবরেটরি রয়েছে। সেখানে নিরিবিলিতে অনুশীলন করতে পারে পড়ুয়ারা। স্কুলের ল্যাবরেটরি মানেই তো সেই হট্টগোল। বর্ধমান শহরের অন্যতম নামী এক স্কুলের প্রধান শিক্ষক শম্ভুনাথ চক্রবর্তীও মনে করেন, “কিছু শিক্ষক স্কুলে গিয়ে পড়ুয়াদের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাচ্ছেন না বলেই কোচিং সেন্টারে যেতে বাধ্য হচ্ছে পড়ুয়ারা।” শিক্ষকদের একাংশের মতেও, কোচিং সেন্টারের হাত থেকে পড়ুয়াদের বাঁচাতে গেলে প্রতিটি স্কুলে শিক্ষকদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর মূল্যায়ন করা উচিত। স্কুলগুলিতে নিয়মিত পরিদর্শনেরও প্রয়োজন। এ ছাড়া শিক্ষকেরা যুগের সঙ্গে নিজেদের জানার পরিধিটাও বাড়াচ্ছেন কি না, তাও দেখা দরকার।

জেলা স্কুল পরিদর্শক দফতরের অবশ্যা দাবি, স্কুল পরিদর্শনের প্রয়োজনীয় কাঠামোই নেই তাঁদের। আধিকারিকেরা জানান, জেলায় ১৪ জন স্কুল পরিদর্শকের (এসআই) জায়গায় রয়েছেন মাত্র চার জন। দফতরে কোনও গাড়িও নেই। তবে জেলা স্কুল পরিদর্শক (ডিআই) খগেন্দ্রনাথ রায় বলেন, “এই পরিকাঠামোর মধ্যেও যতটা সম্ভব আমরা স্কুল পরিদর্শন করে চলেছি।”

শিক্ষাবিদদের দাবি, ক্লাসে নতুন কিছু করতে না পারলে পড়ুয়াদের স্কুলমুখী করা যাবে না। বাঁকুড়া জেলা স্কুল ক্লাসে পড়ুয়াদের প্রশ্ন করাতে উৎসাহ দেওয়ায় সাফল্যের মুখ দেখেছে, সে রকম কিছু ভাবনা বোধহয় ভাবতে হবে এ শহরকেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন