ঝাঁ চকচকে ভবন, ডিজিট্যাল ক্লাসরুম দিতে না পারলেও পড়ানোর ধরণ, স্কুলের পরিবেশের উন্নতি করে বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়ুয়াদের টানতে উদ্যোগী হলেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। অভিভাবকদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানোর ঝোঁকের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে এমনিতেই পিছিয়ে প়ড়ছে মফস্সলের সরকারি, আধা সরকারি স্কুলগুলি। এ বার অভিভাবকদের আস্থা ফিরে পেতে শিক্ষকদের আধুনিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার উদ্যোগ করেছে পূর্বস্থলী দক্ষিণ চক্র সম্পদ কেন্দ্র।
ওই কেন্দ্রের দাবি, শিক্ষক-শিক্ষিকারা কীভাবে নিজেদের মেলে ধরবেন, পড়ুয়াদের সঙ্গে সম্পর্ক কী করে ঘনিষ্ঠ করা যাবে, তা নিয়ে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শুক্রবার ওই কেন্দ্রের দ্বিতল ভবনে একটি আলোচনা সভায় পূর্বস্থলী ১ ব্লকের প্রাথমিক এবং উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আমন্ত্রণ জানিয়ে তা বাতলেও দেওয়া হয়।
এই চক্র সম্পদ কেন্দ্রে প্রাথমিক স্কুল রয়েছে ৮৪টি। এর মধ্যে ৩৫টি স্কুলের ছাত্র সংখ্যা ৫০ ও তার নীচে। অথচ সরকারি ভাবে স্কুলগুলির শিক্ষক, শ্রেণিকক্ষ, সীমানা পাঁচিল, শিক্ষণের সামগ্রী, পানীয় জল, শৌচাগার মতো পরিকাঠামোর অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও ছাত্রসংখ্যা কমছে বলে স্কুলগুলির দাবি। এরপরেই বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষায় নামে পূর্বস্থলীর ওই কেন্দ্র। তাদের দাবি, দেখা যায় গলদ গোঁড়াতেই। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের একটা বড় অংশ নিজেদের মেলে ধরতে ব্যর্থ। এরপরেই ১৪১টি স্কুলের প্রতিনিধিদের নিয়ে দু’দিনের ওই শিবির করেন তাঁরা। সেখানে অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক, সহকারী পরিদর্শক, মনোবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা শিক্ষকদের নিজেদের তুলে ধরার নানা পদ্ধতি দেখান। বেসরকারি স্কুলে অবিভাবকদের ছাত্রছাত্রদের ভর্তি করার প্রবণতা, কীভাবে ইংরেজিতে সহজ ভাবে কথা বলা যায়, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের কীভাবে সহজ উপায়ে শিক্ষাদান করা যায়, বয়ঃসন্ধির সমস্যা, কন্যাশিশুর যত্ন, বাল্য বিবাহ রোধে শিক্ষকদের ভুমিকা নিয়েও আলোচনা হয়।
বিশেষজ্ঞরা জানান, শ্রেণিকক্ষ এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে শিশুদের আগ্রহ জাগে। যেমন, সূর্য, চাঁদ, তারা, গাছ, নানা রকম পাখিদের পোস্টার দিয়ে শ্রেণিকক্ষ সাজানো যেতে পারে। ইংরেজি ভীতি দূর করতে সাধারণ কথাবার্তা ইংরাজিতে করতে হবে। প্রকৃতি চেনাতে হাতেকলমে নিয়ে যেতে হবে। আর যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ডিজিটাল ক্লাসরুম, কম্পিউটার তো লাগবেই। স্কুলগুলিতে কম্পিউটারের সংখ্যা বাড়ানোরও আশ্বাস দেওয়া হয় শিবিরে। এ ছাড়াও পড়ুয়াদের ছোট ছোট দলে ভাগ করে কে, কোথায় পিছিয়ে রয়েছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসেব রাখা, পিছিয়ে প়়ড়া ছাত্রছাত্রীদের আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করারও পরামর্শ দেওয়া হয়। মনোবিদ মোহিত রনদীপ বলেন, ‘‘শিক্ষকদের শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝে কাজ করতে হবে। মারধর নয়, ভালবেসে কাছে টেনে সমস্যার সমাধান করতে হবে।’’ রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শিক্ষক অরূপ চৌধুরীও বলেন, ‘‘ছাত্রছাত্রীদের কাছে স্কুলকে দ্বিতীয় বাড়ি করতে হবে।’’
এই কেন্দ্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক কৃষ্ণেন্দু ঘোষ জানান, আঁকা, খেলাধুলা, স্কুলের পরিবেশ ভাল করায় পারদর্শী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অন্য স্কুলে পাঠানো হবে। প্রশিক্ষণ শিবিরও হবে। এমনকী, শিক্ষকেরা কতটা কাজ করছেন তা খতিয়ে দেখবে একটি কমিটি। কাজে খামতি পেলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও তাঁর দাবি। কাটোয়া ১ ব্লকের সহকারি পরিদর্শক মানবেন্দ্র ঘোষের বক্তব্য, ‘‘দারুণ পদক্ষেপ। জেলায় আগে এমন ভাবা হয়নি।’’ শিবিরে যোগ দিয়ে খুশি শিক্ষক শিক্ষিকারাও। নবকুমার কর, সিরাজুল শেখ, প্রসেনজিৎ সরকাররা বলেন, ‘‘অনেক কিছু শিখেছি। চেষ্টা করব স্কুলে গিয়ে তা প্রয়োগ করার।’’