হারিয়ে যাচ্ছে মন্দিরের গায়ের এই কাজ।—নিজস্ব চিত্র।
কোথাও দেওয়াল বেয়ে উঠে গিয়েছে আগাছা। কোথাও বা আবার পলেস্তরা খসে পড়েছে— এমনই অবস্থা বর্ধমানের রাজাদের দেওয়ান মানিকচাঁদের বসতবাড়ির মধ্যে অবস্থিত মন্দিরগুলির। তবে এ বার ওই মন্দিরগুলি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ ও রাজ্য হেরিটেজ কমিশেনের কাছে আবেদন জানাল বর্ধমানের একটি সংগঠন।
রবিবার বর্ধমানের রাজবাড়ির অদূরেই ময়ূরমহলে মানিক চাঁদের বসতবাড়িতে বর্ধমান হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশন, মানিকচাঁদের উত্তরাধিকারীরা-সহ স্থানীয় বাসিন্দারা একটি বৈঠক করেন। বৈঠকে ঠিক হয় মানিক চাঁদের সম্পত্তির অন্তর্গত পঞ্চরত্ন মন্দির, গিরি গোবর্ধন মন্দির ও শিব মন্দিরের সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগ হবে। মানিকচাঁদের উত্তরাধিকারীরাও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সম্মতি দিয়েছেন। দিলীপ বর্মন, রতনচাঁদ বর্মনদের মতো উত্তরাধিকারীরাও বলেন, ‘‘আর্থিক কারণে মন্দিরগুলি সংস্কার করার সাধ্য নেই আমাদের। তাই আমরা সংস্কারের জন্য সানন্দে অনুমতি দিয়েছি।’’ অ্যাসোসিয়েশনের যুগ্ম সম্পাদক সর্বজিৎ যশ বলেন, ‘‘মন্দিরগুলির বিস্তৃত রিপোর্ট ইতিমধ্যেই হেরিটেজ কমিশনে পাঠানো হবে। তাদের তরফে ছাড়পত্র মিললেই দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।’’ এ দিন সংস্থার তরফে মন্দিরের গায়ের আগাছা পরিষ্কারও করা হয়।
ইতিহাস বলে, মানিকচাঁদের পরিবার পঞ্জাব প্রদেশ থেকে বাংলায় আসেন। মুর্শিদকুলি খাঁ-র সময় থেকে বর্ধমান ‘চাকলা’-র (প্রশাসনিক বিভাগ) কর সংক্রান্ত বিষয় দেখাশোনা করতে শুরু করেন। সেই সূত্রেই বর্ধমানে বসতবাড়ি ও মন্দিরগুলি তৈরি করেন মানিকচাঁদ। পরে সিরাজদৌল্লার হয়ে পলাশির যুদ্ধেও যোগ দেন তিনি। মানিকচাঁদের বসতবাড়ির বর্তমান বাসিন্দারা জানান, মূল প্রবেশ দ্বারটি বিগত বাম পুরবোর্ডের তরফে সংস্কার করা হলেও অবহেলিতই থেকে যায় মন্দিরগুলি। রবিবারের ওই বৈঠকে উপস্থিত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের কিউরেটর রঙ্গনকান্তি জানা বলেন, ‘‘মন্দিরগুলির স্থাপত্য প্রায় ২৭০ বছরের পুরনো। এই মন্দিরগুলির মধ্যে পাহাড়ের চূড়ার মতো আকৃতির গিরি গোবর্ধন মন্দিরটি বিশেষভাবে নজর কাড়ে।’’ বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ডক্টর সৈয়দ তনভির নাসরিনও বলেন, ‘‘মন্দিরের গায়ে ‘পঙ্খ’-এর কাজটি লক্ষ্য করার মতো। মানিকচাঁদের তৈরি করা মন্দিরগুলির ক্ষেত্রে প্রধানত ইট, চুন আর সুরকি ব্যবহার করা হয়েছে।’’ একমাত্র কালনার রাজবাড়ি চত্বরেই এই ধরণের আরও একটি মন্দির রয়েছে বলে ঐতিহাসিকদের দাবি। এই মন্দিরগুলির ছাড়াও বর্ধমানের অন্যান্য প্রাচীন নির্মাণগুলিরও একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সবকটি নির্মাণের ক্ষেত্রেই ধাপে ধাপে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে রঙ্গনকান্তিবাবু জানান।
তবে পুরাতাত্ত্বিক নির্মাণগুলি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিশেষ কয়েকটি সাবধানতা নেওয়া প্রয়োজন বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। স্থানীয় বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেল, সম্প্রতি বর্ধমানের মিঠাপুকুর অঞ্চলের বেশ কয়েকটি মন্দির ও মসজিদের সংস্কার করতে গিয়ে উপযুক্ত সতর্কতা না নেওয়ায় মুছে গিয়েছে সূক্ষ্ম কাজগুলি। ঐতিহাসিকদের দাবি, প্রাচীন এই মন্দিরগুলি সংস্কারের জন্য বিপুল অর্থের পাশাপাশি দরকার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী ও বিশেষজ্ঞেরও। তবে বর্ধমান হেরিটেজ অ্যাসোসিয়েশনের এই উদ্যোগে খুশি এলাকার বাসিন্দারাও। স্থানীয় বাসিন্দা সরোজ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পুরনো মন্দিরগুলির সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ায় শহরের একটি বিশেষ কালপর্বের ইতিহাসকেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।’’