শহরের মোড়ে মোড়ে জমে এমনই আবর্জনা। নিজস্ব চিত্র।
পুর-পরিষেবা নিয়ে বাসিন্দাদের ক্ষোভের শেষ নেই। শাসক দলের গোষ্ঠীকোন্দলে বেশ কয়েক মাস ধরে পুরপ্রধানের পদও ‘টলমল’। তার মধ্যেই জলসঙ্কট দেখা দিয়েছে গুসকরায়। যন্ত্রণায় কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে অলিগলিতে জমে থাকা আবর্জনাও। তার মধ্যে বুধবারই দীর্ঘদিন বেতন না মেলার অভিযোগে, সকাল থেকে কাজ বন্ধ রেখেছেন সাফাইকর্মীরা।
শহরবাসীর ক্ষোভের মাঝে সিপিএমের পাঁচ কাউন্সিলর আবার পুরপ্রধান বুর্ধেন্দু রায়ের নামে পরিষেবা নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন। একই সুর তৃণমূলের পাঁচ কাউন্সিলরেরও। তাঁরাও দলের পুরপ্রধানের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে চিঠি দিয়েছেন উপ-পুরপ্রধানকেও। পৃথক চিঠিতে দু’তরফেরই অভিযোগ, বিগত পুরবোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রতিটি ওয়ার্ডে বিদ্যুতের খুঁটিতে এলইডি আলো লাগানো হবে। অথচ শহরের ১১টি ওয়ার্ডে এলইডি আলো লাগানোর জন্য পুরপ্রধান কোনও কাজের বরাত দেননি। আবার গত ৫ এপ্রিল তলবি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরপ্রধান অপসারিত হয়েছেন। কাজের বরাত দেওয়ার অধিকার তাঁর আর নেই। তাই তিনি পিছনের তারিখ ব্যবহার করে মেমো নম্বর দিয়ে এলইডি আলো লাগানোর জন্য বরাত দিয়েছেন বলেও তাঁদের অভিযোগ। গুসকরার বিরোধী দলনেতা, সিপিএমের মনোজ সাউ বলেন, “এটা স্বেচ্ছাচারিতা ও বৈষম্যমূলক আচরণ। তার বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ।” এলইডি আলো লাগানোর বরাত বাতিলেরও দাবি জানিয়েছেন ওই কাউন্সিররেরা।
পুরসভা সূত্রে জানা যায়, বেশ কয়েক মাস আগে রাজ্য সরকারের কাছ থেকে রাস্তায় এলইডি আলো লাগানোর জন্য আনুমানিক ৩৩ লক্ষ টাকা পেয়েছিল গুসকরা পুরসভা। পুরবোর্ডের সভায় ঠিক হয়েছিল, শহরের ১৭০০টি খুঁটিতেই এলইডি আলো লাগানো হবে। তারপরে টাকা বাঁচলে আলো লাগানো হবে শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেও। কিন্তু সেখানে পুরপ্রধান তাঁর নিজের ওয়ার্ডে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডেই শুধু এলইডি লাগানোর বরাত দিয়েছেন বলে অভিযোগ। পুরপ্রধান বুর্ধেন্দুবাবুও স্বীকার করে নিয়েছেন, পাঁচটি ওয়ার্ড ছাড়া অন্য কোনও ওয়ার্ডে এলইডি লাগানোর বরাত তিনি দেননি। কেন? পুরপ্রধানের ব্যাখ্যা, “বারেবারে পুরবোর্ডের সভা ডাকা হয়েছে এলইডি বন্টনের জন্য। কিন্তু কাউন্সিলরদের একটি গোষ্ঠী সভায় না এসে উন্নয়নের কাজে বাধা দিতে চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত, আমরা অনুন্নত ও আলোর প্রয়োজন রয়েছে এমন ওয়ার্ডগুলিকে বেছে নিয়ে বরাত দিয়েছি।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘ধীরে ধীরে শহর থেকে বাল্ব ও টিউবলাইট তুলে দিয়ে এলইডি লাগানো হবে। আর বাকি অভিযোগ অবান্তর।”
এমনিতেই গুসকরা পুরসভার দ্বন্দ্ব উঠোন ছাড়িয়ে বাইরে পৌঁছেছে। তৃণমূল পুরপ্রধান ও দলেরই তাঁর বিরোধী কাউন্সিলরদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা, বচসা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এমনকী, চুসোচুলি, মারামারির পরে তৃণমূলের পুরপ্রধানকে সরাতে সিপিএমের ও তৃণমূলের পাঁচ জন করে কাউন্সিলর হাতও মিলিয়েছিলেন। পুরপ্রধানকে আস্থা অর্জনের জন্য সভা ডাকার চিঠি দিয়েছিলেন তাঁরা। পুরপ্রধান সেই সভা না ডেকে আদালতের দ্বারস্থ হন। তার মধ্যেই ওই দশ কাউন্সিলর পুরভবনে প্রবীণ কাউন্সিলর নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে সভাপতি করে তলবি সভা করেন। সেই সভায় সব কাউন্সিলরই পুরপ্রধানকে সরানোর পক্ষে রায় দেন এবং উপপুরপ্রধানকে দায়িত্বভার সামলানোর জন্য বলেন। কিন্তু তারপরেও পুরপ্রধান বুর্ধেন্দু রায় পুরসভায় আসছেন। প্রশাসনের তরফেও বিষয়টি নিয়ে নতুন কোনও সিদ্ধান্ত আসেনি। ফলে অচলাবস্থা চলছেই। এ দিকে, শহরের রাস্তায় উপচে পড়া আবর্জনা আর শহরের অধিকাংশ কলে সরু সুতোর মতো দল পড়া নিয়ে ক্ষোভ ছড়াচ্ছে বাসিন্দাদের মধ্যে।
বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের বেশ কিছু এলাকায় নতুন করে জলের সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সেই সব বাড়িতে জল সুতোর মতো করে পড়ছে। আবার সকালে জল পড়লে বিকেলে জল এসে পৌঁছাচ্ছে না। এলাকার বাসিন্দা সীমান্ত দেবরায় কিংবা ভবতোষ মুখোপাধ্যায়দের কথায়, “অসহনীয় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। নিজেরা মারপিট করে শহরের পরিষেবাটা শিকেয় তুলে দিল। আর এই দাবদাহে পানীয় জলের অভাবে ভুগতে হচ্ছে গোটা শহরকে।” রাস্তার ধারে স্তুপীকৃত আবর্জনার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী-মহলও। শহরের ছোট-বড় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, শহরের মূল রাস্তার ধারে ১০ দিন অন্তর আবর্জনা সাফ করা হয়। ফলে পূতিময় গন্ধে পথচারী থেকে ব্যবসাদারেরা জেরবার হয়ে পড়ছেন। দিনের পর দিন নর্দমা পরিস্কার হয় না বলে শহরের বিভিন্ন পাড়ার বাসিন্দারা দুর্গন্ধের মধ্যেই বাস করতে বাধ্য হচ্ছেন। গুসকরার প্রবীণ কাউন্সিলর নিত্যানন্দ চট্টোপাধ্যায় কোনও রকম রাখঢাক না করেই বলেন, “পুরপ্রধান না সরলে শহরটাই মৃতপ্রায় হয়ে যাবে।”
তবে সব অভিযোগের পরেও পুরপ্রধানের দাবি, “আমাদের শহরের মতো পরিষেবা অন্য শহর দিতে পারে না। যাঁরা এ কথা বলছেন, তাঁরা শহরকে ভালবাসেন না। শুধু রাজনীতি করেন।”