দুয়ারে দুগ্গা, ফাঁকা পড়ে বাবলা গ্রামের উৎপল মঞ্চ। নিজস্ব চিত্র
১৯৯৮ সাল। দীর্ঘ কয়েকদশক পর গ্রামের নতুন প্রজন্ম দুর্গাপুজোর জন্য তৈরি হয়েছে। সদ্য প্রয়াত অভিনেতার স্মৃতিতে পুজোর জন্য তৈরি আটচালার নাম রাখা হয়েছে ‘উৎপল মঞ্চ’। কলকাতার কুমারটুলি থেকে প্রতিমা এসেছে। পুরো গ্রাম সেজেছে আলোয়। ধুনুচি নাচে বোধনও হয়ে গিয়েছে দেবীর। কিন্তু অষ্টমীর সকালেই থমকে গেল সব। ঘটি ডোবে না যে পুকুরে সেখানেই সলিল সমাধি ঘটল গ্রামের যুবক সাগর সেনের।
কুড়ি বছর আগের ওই সকাল বদলে দিয়েছে গলসি ২ ব্লকের বাবলা গ্রামকে। রামপুর মোড়-ইরকোনা এলাকার শ্মশান লাগোয়া পুকুরে সাগরের মৃত্যুর পরে উদ্যোক্তারা ক্ষোভে প্রতিমা ভেঙে দেন। তারপর থেকে পুজো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন গ্রামের বাসিন্দারা। গ্রামের ভীমডাঙায় রয়েছে মনসা মন্দির, শিব মন্দির, রক্ষাকালী মন্দির, রাধাকৃষ্ণের নাটমন্দির। কিন্তু দুর্গোৎসব এখানে ব্রাত্য। উৎপল মঞ্চ খাঁ খাঁ করে। কুকুর-ছাগল আড্ডা দেয়।
গ্রামের ভিতর দিকে সাগর সেনের বাড়ি। ছেলের শোকে পাথর মা বাসন্তীদেবীও কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। পরিজনেরা বাড়ি বিক্রি করে চলে গিয়েছেন। কিন্তু গ্রামে পুজো আর ফেরেনি। প্রবীণেরা জানান, সেনদের পূর্বপুরুষরাই গলসিরই আদ্রাহাটি থেকে এ গ্রামে এসে দেড়শো বছর আগে পুজো শুরু করেন। কিন্তু পুজো শুরুর বছর খানেকের মধ্যেই ওই পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু হতে থাকে। বাড়ির জামাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে বন্ধ হয়ে যায় পুজো। পরে ১৯৯৮ সালে গ্রামের নতুন প্রজন্ম ঠিক করে, পুরনো বিশ্বাস ভুলে পুজোয় আনন্দ করবে তাঁরাও। দুর্গাপ্রতিমা আসবে গ্রামে। শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। পুজোর অন্যতম উদ্যোক্তা অরিন্দম নন্দী বলেন, “সেন বাড়ির সাগরই একমাত্র আমাদের পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিল। অষ্টমীর সকালে ১০৮টা পদ্মফুল তুলতে পুকুরে নেমেছিল ও। শ’খানেক পদ্ম তোলার পরে একবার উঠে আসে। তারপর বাকিগুলি তোলার জন্য জলে নামতেই ডুবে যায়।’’
স্থানীয় হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু প্রবীরদের কথায়, “সাগর বড় বড় পুকুরে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটত। দামোদর পারাপার করত। সে কিনা ছোট পুকুরে ডুবে গেল! সবই মায়া!” সাগরের নিথর দেহ আসার পরে সব ক্ষোভ গিয়ে পড়ে প্রতিমার উপর। আবালবৃদ্ধ সবাই মিলে প্রতিমাটি ভেঙে ফেলেন। গৌরীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বপ্না কেশদের কথায়, “পুজোর সময় গ্রাম খালি হয়ে যায়। দেখে মনে হয়, কয়েকজন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন।’’ তবে দশমীতে কোলাকুলি, নাড়ু দেওয়া, সবই হয়।
কিন্তু কুড়ি বছরের পুরনো দুর্ঘটনার জন্য পুজোর আনন্দ থেকে নিজেদের বঞ্চিত করা কী ঠিক? বৃদ্ধা বিভা পাঁজা বলে ওঠেন, “মাকে আনতে গিয়ে ছেলের মৃত্যু কী মেনে নেওয়া যায়?” পাশে দাঁড়ানো সুমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “উৎপল মানে তো পদ্ম। মায়ের পুজোর পদ্ম তুলতে গিয়েই ডুবে গেল সাগর।’’
খাঁ খাঁ করে উৎপল মঞ্চ।