দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়ি। শনিবার গলসিতে। ছবি: উদিত সিংহ
ধীর গতির সাইকেল, মোটরবাইক বা মোটরভ্যান চলছেই।
লরি-ট্রাকের ‘লেন’ ভাঙারও বিরাম নেই। বাড়তি উপদ্রব গরু-বাছুর নিয়ে গ্রামবাসীদের উপস্থিতি। সব মিলিয়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে এখন সাক্ষাত্ মৃত্যুফাঁদ। নানা পয়েন্টে রয়েছে পুলিশের মোবাইল ভ্যান, পুলিশ কিয়স্ক, সিভিক ভলান্টিয়ারদের নজরদারি। তা সত্ত্বেও এড়ানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা। শনিবার সকালে ফের গলসির মানিকবাজার এলাকায় ট্রাকের ‘লেন’ ভাঙার বলি হলেন পাঁচ জন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকালে কলকাতা থেকে দু’টি গাড়িতে ১৪ জন গিরিডির কাছে একটি জৈন মন্দিরে পুজো দিতে যাচ্ছিলেন। গলসির মানিকবাজারের কাছে দু’টি ডিভাইডারের ফাঁক দিয়ে একটি ধান বোঝাই ট্রাক আচমকা ঢুকে আসে। সামনের গাড়িটি ওই ট্রাকে ধাক্কা মেরে নয়ানজুলিতে উল্টে যায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান কলকাতার হেয়ার স্ট্রিট এলাকার বাসিন্দা ইচরাজদেবী ডাকালিয়া (৭২), তার পুত্রবধূ কুমুদদেবী ডাকালিয়া (৫৪), কুমুদদেবীর দিদি, টালিগঞ্জের বাসিন্দা পুষ্পাদেবী গুলগুলিয়া (৬৯), গাড়ির চালক আফজল শেখ (৪০) ও কাঁকসার বাসিন্দা, পথচারী জ্যোত্স্না আকুঁড়ে (২২)। দুর্ঘটনায় জখম হন ইচরাজদেবীর স্বামী রাজেশ এবং তাঁদের আত্মীয়া সুমন নাহাত্। দুর্ঘটনাগ্রস্ত গাড়িটিতে একটি সর্বভারতীয় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের স্টিকার ছিল। তবে, গাড়িটি ভাড়া খাটত বলে পুলিশের অনুমান। নিরাপদে এবং দ্রত গন্তব্যে পৌঁছতে ঝাঁ-চকচকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের জন্য মোটা টাকা ‘টোল’ দিতে হয় যাত্রীদের। অথচ, রাজ্যের অন্যতম সেরা এই জাতীয় সড়ক ক্রমশই যানচালকদের কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে। ডানকুনি ও দুর্গাপুরের মধ্যে প্রায় ৬১ কিলোমিটার বিস্তৃত এই সড়কে গাড়ির দ্রুত গতিতে যাওয়ার কথা। কিন্তু যানচালকদের মাঝেমধ্যেই গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। কেননা, বিভিন্ন জায়গায় ডিভাইডারের ‘কাট’-এর সুযোগ নিয়ে গাড়ি ঢুকে অন্য ‘লেন’-এ চলে যাচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে ধীর গতির সাইকেল বা মোটরভ্যান। আবার একই লেনে উল্টো দিকের গাড়ি চলে আসাও প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা। অনেকেই দুর্ঘটনায় পড়ছেন। বহু দেশে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ির গতিবেগের উপরে নির্দিষ্ট ‘লেন’ থাকে। গতি কমানো বা ‘লেন’ পাল্টানোর জন্য নির্দিষ্ট নিয়মও থাকে। কিন্তু দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে সে সবের বালাই নেই।
কেন ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন? রাজ্য পুলিশের এক কর্তার দাবি, ডানকুনি থেকে পালসিট পর্যন্ত ওই সড়কের দু’দিকেই গ্রাম। গ্রামবাসীরা এক্সপ্রেসওয়ের ব্যাপারে সচেতন নন। তাই সাইকেল, মোটরবাইক, গরু-বাছুর নিয়ে তাঁরা হামেশাই সড়কে চলে আসছেন। লেন পাল্টাচ্ছেন। দুর্ঘটনাও ঘটছে। সচেতনতা বাড়ানোর জন্য থানাগুলি প্রচারও করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে না। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের কাছে সড়কের ধারে বেড়ার ব্যবস্থা করতে আবেদন জানানো হয়েছে। হুগলির পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী বলেন, “ওই সড়কে আমাদের ছ’টি থানা এলাকায় যান নিয়ন্ত্রণের জন্য পাইলট-কার রয়েছে। ডানকুনি, সিঙ্গুর-সহ আরও কিছু জায়গায় ট্রাফিক কিয়স্ক রয়েছে। কিন্তু এখানে রাস্তার এলাকা এত কম যে বিদেশের মতো গাড়ির গতিবেগের উপরে নির্দিষ্ট লেন করা দুরূহ।”
জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের তরফে প্রকল্প অধিকর্তা কৃষ্ণমুরারী মন্তব্য করতে চাননি। অন্য এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “বিপদের কথা না ভেবে এক শ্রেণির চালক বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালান। তাতেই বিপদ ডেকে আনেন। সড়কের ধারে বেড়ার ব্যবস্থা করলে অবাঞ্ছিত প্রবেশ এড়ানো যাবে। সেই পরিকল্পনা আমাদের মাথায় রয়েছে।” তিনি মেনে নিয়েছেন, বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চলায় ওই সড়কের বেশ কিছু জায়গায় একই ‘লেন’ দিয়ে দু’দিকের গাড়ি চালানো হচ্ছে। বিদেশের মতো গাড়ির গতিবেগের উপরে নির্দিষ্ট লেন করা দুরূহ বলে তিনিও দাবি করেছেন।
এ দিনের দুর্ঘটনায় আহতদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। দুর্ঘটনায় আহত সুমন নাহাত্ বলেন “ট্রাকটি কোনও সিগন্যাল না মেনে লেন ভেঙে হঠাত্ই আমাদের গাড়ির সামনে চলে আসে।” আহত রাজেশ ডাকালিয়া বলেন, “আমাদের গাড়িটি ঘণ্টায় প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে চলছিল। ট্রাকটি হঠাত্ করেই সামনে আসার পর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে গাড়িটি ধাক্কা মারে।”
‘লেন’ ভাঙা এড়ানো গেলে এমন দুর্ঘটনাও এড়ানো যেত বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।