মেতেছে রাঙাপাড়া। —নিজস্ব চিত্র।
বসন্তের শুরুতে দেশ জুড়ে হোলির কৃত্রিম রঙের ছিটে লাগছে যখন, তখন তাঁরা স্রেফ প্রকৃতি থেকেই ফুল, ফল নিয়ে আর একে অপরের গায়ে জল ছিটিয়ে উৎসব পালন করছেন। এই উৎসবের দৃশ্য বারবার দেখা গিয়েছে প্রাচীন ভারতীয় লোক-শিল্প থেকে বর্তমান সন্ন্যাসী লোহারের আঁকা ছবিতেও। উৎসবের পোশাকি নাম ‘বাহা’। আর এই উৎসব উপলক্ষে আনন্দে ভাসছেন বার্নপুরের রাঙাপাড়া গ্রামের শতাধিক আদিবাসী পরিবার।
গ্রামের মোড়ল চৈতন টুডু জানান, বসন্তকে স্বাগত জানাতেই এই উৎসব পালন করা হয়। মূলত গাছ, পাথর, জল, ফুল, ফল-সহ প্রকৃতিকে আহ্বান করা হয় উৎসবটির মধ্য দিয়ে। তিন দিনের এই উৎসবটি শেষ হয় দোলের দিন। ভাষাবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘বাহা’ শব্দটির আসল অর্থ ‘ফুল’ (মতান্তরে মহুয়া ফুল)। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ‘বাহা’ উৎসবটি সারুল বা সারহুল নামেও পরিচিত। উৎসবের মাধ্যমে মারাং বুরু, জহের আয়ু প্রভৃতি আদিবাসীদের দেবতারা আরাধনা করা হয় বলে বিশেষজ্ঞরা জানান। গ্রামবাসীদের সূত্রে জানা গেল, প্রথম দিন গ্রাম সাফাইয়ের দিন। এই দিনটিকে লোক শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয় ‘সিন্নান’। গ্রামের প্রধান পুরোহিতের (স্থানীয় ভাষায় ‘নাইকি’) বাড়ির উঠোনেই উৎসবের সূচনা করেন গ্রামবাসীরা। মূল অনুষ্ঠান স্থানটির নাম বাহের থান। গ্রামের প্রতিটি পরিবারকে বাধ্যতামূলকভাবে উৎসবে যোগ দিতে হয় বলে বাসিন্দাদের সূত্রে জানা গেল। গ্রামের প্রতিটি পরিবার থেকে পুজোর নৈবেদ্য রূপে আসে চাল, ডাল, সব্জি ও মুরগি। বুধবার, উৎসবের দ্বিতীয় দিন। এই দিনটির পোশাকি নাম ‘সার দিমাহা’। এ দিন গ্রামে গিয়ে দেখা গেল প্রধান পুরোহিতের বাড়ির উঠোনে পুজোর নৈবেদ্য নিয়ে জড়ো হয়েছেন বাসিন্দারা। নিষ্ঠা ভরে পুজো সারছেন প্রধান পুরোহিত বাহা টুডু। একটি শাল গাছের (স্থানীয় ভাষায় ‘জোহের গার্হে’) নীচে শাল ফুল দিয়েই সাজানো হয়েছে পুজো মণ্ডপ। পুজো শেষে গ্রামের মহিলারা শুরু করলেন যাতুর নাচ। দ্রিম দ্রিম আওয়াজে সঙ্গত জোগাল ধামসা, মাদল। কিছুক্ষণ পরে প্রধান পুরোহিত গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের গায়ে জল ছিটিয়ে দিলেন। হাতে তুলে দেওয়া হল শাল ফুল। এর সঙ্গেই মিলল দোল খেলার অনুমতিও। দেখা গেল প্রত্যেকের হাতে রঙের বদলে রয়েছে জল। জল ছিটিয়েই ফাগুনের আনন্দ মেতে উঠলেন ওঁরা। খেলা চলবে বৃহস্পতিবারও। বাহা উৎসবের তৃতীয় দিনটিকে বলা হয়, ‘সেন্ড্রা’। এর অর্থ শিকারের দিন। তরুণ প্রজন্মের বাসিন্দা হীরালাল সোরেন বলেন, “এই বিশেষ দোল খেলার একটি শর্ত রয়েছে। একমাত্র বন্ধু স্থানীয়দের মধ্যেই জল ছেটানো যাবে।”
কিন্তু রঙের বদলে জল কেন? -- হীরালালবাবু জানান, এটি প্রকৃতির উৎসব। রঙ কৃত্রিম। কৃত্রিমতাকে দূরে সরিয়ে রাখতেই জলের ব্যবহার।