জলপ্রকল্পের উদ্বোধনে। নিজস্ব চিত্র।
মাদুর বুনে, মুড়ি ভেজে রোজগার শুরু। তারপর এক, দুই করে দু’শোর উপর স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে ফেলেন পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরের মেয়েরা। ক্লাস্টার গড়ে, ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে পরিধি বাড়তে থাকে ব্যবসার। সদস্য সংখ্যাও চার হাজার ছাড়িয়ে যায়। এ বার পরিস্রুত পানীয় জলের প্রকল্প গড়ে আরও এক ধাপ এগোলেন তাঁরা। ওই ক্লাস্টারের সদস্যদের দাবি, কম দামে এলাকার বাইরের বাজারেও পরিস্রুত জল সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের।
শুরুটা অবশ্য সহজ ছিল না। তাঁত এলাকা হিসাবে পরিচিত শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতে বাড়ির পুরুষেরা যা রোজগার করতেন তাতে বেশিরভাগ সংসারই স্বচ্ছন্দে চলত না। আবার মেয়েরা যে কাজ করবেন, সে ক্ষেত্রেও সঠিক পথ দেখানোর কেউ ছিল না। সমস্ত পরিবার তা মেনে নিতেও রাজি ছিল না। ২০০৪ সাল থেকে অবশ্য পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী গড়ে এগিয়ে আসে বাড়ির মেয়ে-বউরা। নিজেরা কিছু টাকা জমিয়ে ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে কেউ বালুচরি শাড়ি, কেউ মাদুর তৈরি আবার কেউ মুড়ি ভেজে নিজেদের মেলে ধরে। কয়েকটি গোষ্ঠীর সাফল্য বাকিদেরও প্রেরণা জোগায়। সরকারি সুবিধা, প্রশিক্ষণ মিলতে থাকে। জড়তা কাটিয়ে বহু পুরুষও বাড়ির মহিলাদের সাহস জোগায়। পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতি সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি বছর পর্যন্ত শ্রীরামপুর পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ২৩০টি স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। যার মধ্যে ২২২টি গোষ্ঠীই মহিলা সদস্যদের হাতে তৈরি। এই সমস্ত স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মিলিত সদস্য প্রায় চার হাজার। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য তাঁদের ৫ কোটিরও বেশি ব্যাঙ্ক ঋণ রয়েছে। সারা বছরের লেনদেন প্রায় দশ কোটি টাকা। এই সমস্ত স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীগুলির সদস্যদের সঞ্চয় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। পঞ্চায়েতের দাবি, প্রতিটি গোষ্ঠী নিয়ম করে ব্যবসা করে ব্যাঙ্ক ঋণ শোধ করে। ফলে ব্যাঙ্কগুলিও ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে।
২০০৯ সালে এই গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হয়ে ‘সর্বজয়া’ নামে একটি ক্লাস্টার শুরু করে। পঞ্চায়েতের তরফে তাদের একটি কার্যালয়ও দেওয়া হয়। পরে কার্যালয়টিকে উন্নত চেহারায় তৈরির জন্য জেলা গ্রাম উন্নয়ন দফতর ১২ লক্ষ টাকা অনুমোদন করে। বছর দুয়েক আগে সর্বজয়া ক্লাস্টার ঢেঁকি ছাটা চাল তৈরির প্রকল্প হাতে নিয়েছে। স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর মেয়েদের এই প্রচেষ্টা গোটা জেলাতেই সারা ফেলে দেয়। সম্প্রতি ক্লাস্টারের সদস্যেরা ঠিক করেন নিজেদের ব্যাবসাকে আরও বৃহত্তর আঙিনায় ছড়িয়ে দেবেন তাঁরা, যার মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতাও থাকবে। তখনই নিজেদের আর্সেনিক অধ্যুষিত এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলের প্রকল্প তৈরি করে যতটা সম্ভব কম দামে বিক্রি করার পরিকল্পনা নেন তাঁরা। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যদের ইচ্ছায় সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে এলাকার একটি ব্যাঙ্ক। ১০ লক্ষ টাকার প্রকল্পে ব্যাঙ্ক ঋণ দেয় ৯ লক্ষ টাকা। এরপরেই সংস্থার কার্যালয়ের একতলায় বসানো হয় ‘রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার প্ল্যান্ট’, যেখানে গভীর নলকূপের মাধ্যমে তোলা জল প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার লিটার পরিস্রুত করা সম্ভব।
সর্বজয়া ক্লাস্টারের দলনেত্রী সুতপা দেবনাথ জানান, এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলের চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। সেদিকে তাকিয়েই এই ধরনের প্রকল্প। বাজার খোঁজা থেকে শুরু করে জার ভর্তি জল বিক্রি-- প্রকল্পের সমস্তটাই মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত। ভবিষ্যতে বোতলের জল বাজারে আনারও পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান তিনি। ক্লাস্টারের আর এক সদস্য সবিতা মজুমদারও নিজেদের প্রকল্প নিয়ে আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেন, “এত বড় পরিকল্পনা আগে কোনও স্বনির্ভর গোষ্ঠী নেয়নি। আমাদের মেয়েরাই এই প্রকল্পকে ব্যবসায়ীক রূপ দেবে।” তাঁর দাবি, শুধু জলের ব্যবসা নয়, সরকারি সাহায্যে ক্লাস্টারের সদস্যদের পাটের ব্যাগ তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়াও শুরু হয়েছে। এর থেকেও রোজগার হচ্ছে মেয়েদের। ওই ভবনের দোতলাটি একটি তাঁত ক্লাস্টারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে বছরে ভালই ভাড়া মিলছে বলে জানান সদস্যেরা। বিনা সাহা, পিয়ালি মণ্ডলদের কথায়, “পঞ্চায়েত এলাকায় ২৪টি বুথ রয়েছে। প্রতি বুথ থেকে ২ জন করে সদস্য থাকবে যারা ঢেঁকি ছাটা চাল এবং পরিস্রুত পানীয় জলের বাজার খোঁজার দায়িত্বে থাকবে। পাশাপাশি চেষ্টা চলছে ঘরে ভাজা মুড়ির একটি প্রকল্প গড়ার।”
সম্প্রতি নিজেদের কার্যালয়ে ঘটা করে জল প্রকল্পের উদ্বোধন করেন সর্বজয়া ক্লাস্টারের মেয়েরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসনের আধিকারিক, সবার মুখেই ছিল একটি পঞ্চায়েত এলাকার মেয়েদের এগিয়ে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের প্রশংসা। স্বপনবাবু বলেন, “এই এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জলের ভাল চাহিদা রয়েছে। আশা করছি মেয়েরা সফল হবে। সরকার ওদের পাশে রয়েছে।” অনুষ্ঠানে সর্বজয়া ক্লাস্টারের প্রশংসা করেন অতিরিক্ত জেলাশাসক রুমেলা দে এবং অতিরিক্ত মিশন ডিরেক্টর আনন্দ ধারা। পূর্বস্থলী ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি দিলীপ মল্লিকের কথায়, “শ্রীরামপুরের মেয়েদের লড়াই সারা জেলার মেয়েদের পথ দেখাবে।”