লোকনাথ দেবনাথ।—নিজস্ব চিত্র।
সজল ঘোষ খুন হওয়ার পরেও দেড় দিন পূর্বস্থলীতেই ছিল লোকনাথ দেবনাথ, তবুও পুলিশ তাকে ধরেনি বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতাদের।
খুনের রাতেই তড়িঘড়ি নবদ্বীপের বাড়ি থেকে তুলে আনা হয়েছিল সিপিএম নেতা প্রদীপ সাহাকে।
প্রায় তিন বছর মামলা চালিয়েও পুলিশ তাঁর অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। গত সপ্তাহেই বেকসুর খালাস হয়ে গিয়েছেন তিনি। অথচ যে লোকনাথ গুলি চালিয়েছিল বলে অভিযোগ, তাকে কেন পুলিশ ধরতে পারল না সেই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি।
পূর্বস্থলী উত্তরের তৃণমূল বিধায়ক তপন চট্টোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের যতটা তৎপর হওয়া প্রয়োজন ছিল, পুলিশ ততটা তৎপর হয়নি। ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি রাতে সজল খুন হয়। তার পরেও লোকনাথ পূর্বস্থলী এলাকাতেই ছিল এবং ১১ জানুয়ারি সে এলাকা ছেড়ে পালায় বলে আমাদের কাছে খবর। পুলিশ তাকে ধরেনি।” মামলার ‘প্রত্যক্ষদর্শী’, বর্তমানে তৃণমূলের রাজ্য কমিটির সদস্য ফজলুল হক মণ্ডলের দাবি, “লোকনাথকে ধরার ব্যাপারে পুলিশের কোনও তৎপরতা আমার চোখে পড়েনি। সেই ঢিলেঢালা অবস্থার সুযোগ নিয়ে সে হয়তো বাংলাদেশে পালিয়েছে।”
বর্ধমানের পূর্বস্থলী কলেজের এসএফআই নেতা লোকনাথ যে আদতে বাংলাদেশি, তা অবশ্য পুলিশ গোড়া থেকেই জানত। স্থানীয় সূত্রের খবর, লোকনাথের বাবা ডালিম এবং মা কমল দেবনাথ বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা। তবে স্কুলে পড়ার সময় থেকেই পূর্বস্থলীর পারুলিয়া অঞ্চলে শ্যামবাটিতে সে দাদু-দিদিমার কাছে থাকত। পূর্বস্থলীর ভোটার তালিকায় ২৩৩ নম্বর বুথের ৪৯৯ নম্বরে তার নামও রয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, ত্রিপুরায় তাদের আত্মীয় রয়েছে শুনে নবদ্বীপ থানার একটি দল সেখানে গিয়েছিল। কিন্তু কারও কোনও খোঁজ মেলেনি। বাংলাদেশে গিয়ে সে গা-ঢাকা দিয়েছে কি না, তার স্পষ্ট উত্তরও দিতে পারেনি পুলিশ। নদিয়ার পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ অবশ্য দাবি করেন, “লোকনাথের খোঁজে প্রথম থেকেই সব রকম চেষ্টা করা হয়েছে।”
বছর তিনেক আগে ওই দিন, ৯ জানুয়ারি পূর্বস্থলী কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমা নিয়ে এসএফআই এবং টিএমসিপি-র সংঘর্ষ হয়েছিল। টিএমসিপি-র দু’জন এবং এসএফআইয়ের এক জখম সমর্থককে পরে নদিয়ার নবদ্বীপ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। রাতে তাদের দেখতে বেশ কয়েক জনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে যান বিধায়ক তপনবাবু। তৃণমূলের অভিযোগ ছিল, সেখানেই সজলকে ডাকিয়ে এনে প্রদীপ সাহা তাকে জাপটে ধরেন, লোকনাথ বুকে রিভলভার ঠেকিয়ে তাঁকে গুলি করে। তার পরে প্রদীপবাবুর মোটরবাইকে চেপেই তারা পালায়। প্রদীপবাবু
প্রথম থেকেই দাবি করে এসেছেন, তিনি আদৌ ঘটনাস্থলে যাননি।
তাঁকে ফাঁসানো হচ্ছে। কিন্তু লোকনাথও ঘটনাস্থলে ছিল না বা তাকে ফাঁসানো হচ্ছে, এমন দাবি সিপিএমের তরফে কখনও আদালতে করা হয়নি।
প্রশ্ন হল, পুলিশ যদি সব রকম চেষ্টা করেই থাকে, লোকনাথ ধরা পড়ল না কেন? তবে কি সিপিএমের পূর্বস্থলী জোনাল সদস্য তথা কুলকামিনী হাইস্কুলের প্রধান প্রদীপ সাহাকে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করেই পুলিশ ভেবে নিয়েছিল ‘কাজ’ হয়ে গিয়েছে? তৃণমূল নেতারা কেন চাপ দিলেন না? তাঁরা যদি সত্যি জানতেন যে লোকনাথ এলাকায় রয়েছে, তাকে ধরিয়েই বা দিলেন না কেন? সিপিএম গোড়া থেকেই দাবি করে এসেছে, প্রদীপবাবুকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। এখন তৃণমূলের একটি মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে, সেই ‘ফাঁসানো’র কাজটা চটপট হয়ে যাওয়াতেই কি আর লোকনাথের কথা তেমন ভাবে মাথায় ছিল না নেতাদের? সে গ্রেফতার হল কি না সেটা তখন গৌণ হয়ে গিয়েছিল এবং যখন ফের টনক নড়ে, তখন পাখি হাওয়া?
পূর্বস্থলীর অন্যতম প্রভাবশালী নেতা প্রদীপ সাহার নাম যে পরিকল্পনা মাফিক খুনের মামলায় জড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তা তৃণমূল নেতারা অবশ্যই স্বীকার করছেন না। বরং প্রদীপবাবু-সহ ধৃত পাঁচ জনের দোষ প্রমাণ না হওয়া এবং লোকনাথ ধরা না পড়ায় তাঁরা পুলিশকেই দুষছেন। মামলার অন্যতম ‘প্রত্যক্ষদর্শী’, পূর্বস্থলী পঞ্চায়েতের প্রধান পঙ্কজ গঙ্গোপাধ্যায়ের দাবি, “এত গুরুত্বপূর্ণ মামলায় পুলিশ গোড়া থেকে এমন সব কাজ করেছে, যার ব্যাখ্যা সাধারণ বুদ্ধিতে মেলে না। সজলের রক্ত ওরা ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠায়নি, ময়নাতদন্তে দেহ থেকে পাওয়া গুলিও বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠায়নি। খুনের রিভলভার তো তারা উদ্ধার করতে পারেইনি, গুলিটিও আদালতে হাজির করেনি।” তপনবাবুর দাবি, “আমরা নই, আসলে প্রদীপ সাহাকে গ্রেফতার করে পুলিশই আত্মসন্তুষ্ট হয়ে পড়েছিল।”
লোকনাথকে তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দিলেন না কেন?
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য অঞ্জু কর পাল্টা বলেন, “তাকেও যে প্রদীপদের মতো ফাঁসানো হয়নি, তা কী করে জানব? তা ছাড়া সে বেঁচে আছে কি না, সেটাই তো আমরা জানি না! তিন বছর ধরে ছেলেটার খোঁজ নেই। কেন? পুলিশকেই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।”
লোকনাথ কোথায় এবং সে-ই আসলে খুনি কি না, এই দুই প্রশ্নই আপাতত উত্তরহীন রয়ে গেল।