প্রার্থীদের নিয়েই চিন্তায় দুই শিবির

মার্ক্স-লেনিন-নেতাজির বদলে দেওয়ালে ঝুলছেন মমতা-মুকুল-অনুব্রত। আর তাঁদের নীচে বসে বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বলছিলেন, “জানেন, সিপিএম এখন আর বামপন্থী নেই। মমতাই আসল বামপন্থী।” নেত্রীর মতো তাঁর পায়েও গলানো হাওয়াই চপ্পল। জার্সি বদলের পর গায়ের পাঞ্জাবিটাও সবুজ। ছিলেন গলসির ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক। রাজ্যসভা নির্বাচনের পর হয়ে গেলেন তৃণমূল। কাটোয়ায় ‘নতুন’ দলের পার্টি অফিসে বসে সেই সুনীল মণ্ডলেরই আক্ষেপ, সিপিএম আর বামপন্থী নেই।

Advertisement

রঞ্জন সেনগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৫৩
Share:

মার্ক্স-লেনিন-নেতাজির বদলে দেওয়ালে ঝুলছেন মমতা-মুকুল-অনুব্রত। আর তাঁদের নীচে বসে বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী বলছিলেন, “জানেন, সিপিএম এখন আর বামপন্থী নেই। মমতাই আসল বামপন্থী।”

Advertisement

নেত্রীর মতো তাঁর পায়েও গলানো হাওয়াই চপ্পল। জার্সি বদলের পর গায়ের পাঞ্জাবিটাও সবুজ। ছিলেন গলসির ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক। রাজ্যসভা নির্বাচনের পর হয়ে গেলেন তৃণমূল। কাটোয়ায় ‘নতুন’ দলের পার্টি অফিসে বসে সেই সুনীল মণ্ডলেরই আক্ষেপ, সিপিএম আর বামপন্থী নেই।

আক্ষেপটা সুনীলবাবুর মতো অনেকেই করেন। কিন্তু এমন ‘প্রকৃত বামপন্থী’ কেন সটান শত্রু-শিবিরে ঢুকে পড়লেন (এবং হাতেগরম ভোটের টিকিটটাও পেয়ে গেলেন), সেই প্রশ্নও তো তুলছে ডাইনে-বাঁয়ে সকলেই। এবং উত্তরটাও দিয়ে দিচ্ছে। সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদক অমল হালদার বলছেন, “উনি (সুনীলবাবু) তো কার্যত বিক্রি হয়ে গিয়েছেন।” প্রতিপক্ষ সম্পর্কে সিপিএম প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাস আরও চাঁছাছোলা “বিক্রি হয়ে যাওয়া বামপন্থী।” বিজেপি প্রার্থী সন্তোষ রায়ের কটাক্ষ, “বামফ্রন্টে থাকাকালীন তো মমতার দলকে ঠেঙিয়েছেন। এখন মনে হচ্ছে মমতা প্রকৃত বামপন্থী, ভাল নেত্রী! এই ধরনের নীতি-আদর্শহীন মানুষকে কেউ পছন্দ করে না।”

Advertisement

তৃণমূল প্রার্থী এ সব অভিযোগ একেবারেই গায়ে মাখতে নারাজ। তাঁর যুক্তি, ফরওয়ার্ড ব্লকে থাকলেও দল ছেড়েছেন সিপিএমের দাদাগিরির কারণে। তাঁর কথায়, “ধর্মস্থ বলছি, ভেবেছিলাম রাজনীতিই ছেড়ে দেব। কিন্তু গলসির বাম বিধায়ক হওয়া সত্ত্বেও উন্নয়নের প্রশ্নে দিদি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। তাই দিদি, মুকুলদার অনুরোধ ফেলতে পারিনি। ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলের যোগ দিয়েছি।”

অথচ ‘দিদি’র দলে যোগ দিয়েও পুরস্কার হিসেবে পাওয়া লোকসভার টিকিটটা যেন সুনীলবাবুর গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলের অন্দরেই ক্ষোভ ছড়িয়েছে এক জন সদ্য-দলত্যাগীকে প্রার্থী করা নিয়ে! সেই ক্ষোভ সামাল দিতে কার্যত নাকাল সুনীলবাবু নিজে এবং তাঁর অধুনা মেন্টর, রাজ্যের পশুপালন মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ। সিপিএমের বর্ধমান জেলা কমিটির সম্পাদকও যা নিয়ে খোঁচা দিয়েছেন, “প্রার্থী হওয়ার জন্য প্রকৃত তৃণমূলের কাউকে পাওয়া গেল না?”

কটাক্ষ শুনে নিজের গড়, পূর্বস্থলী দক্ষিণের পার্টি অফিসে বসে মুখে আলতো হাসি ঝুলিয়ে মন্ত্রী স্বপন দেবনাথের সংক্ষিপ্ত উত্তর, “দিদি প্রার্থী ঠিক করেছেন। তিনি সুনীল মণ্ডলকে যোগ্যতম মনে করেছেন। তাই এ নিয়ে জেলায় কোনও ক্ষোভ নেই। আমারও নেই।”

বর্ধমান-পূর্ব লোকসভা কেন্দ্রের বিভিন্ন প্রান্তে কান পাতলে যদিও অন্য গল্প শোনাচ্ছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাই। জানা যাচ্ছে, দলের জেলা নেতাদের একটা বড় অংশ এক বিধায়ককে প্রার্থী হিসেবে চেয়েছিলেন। তা হয়নি। তাই কালনা-কাটোয়া-মেমারি-জামালপুরের মতো বিধানসভা এলাকায় সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়েছে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। এবং তা নেতাদের এতটাই চিন্তায় রেখেছে যে, ভোটের (৩০ এপ্রিল) কুড়ি দিন আগেও কর্মিসভার মঞ্চে সব নেতাদের হাজির হয়ে বলতে হচ্ছে, “আমাদের একসঙ্গে লড়তে হবে!”

তবে শুধু কি তৃণমূল? সিপিএমও তাদের নতুন প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাসকে নিয়ে কম বিড়ম্বনায় নেই। গোটা রাজ্যে একমাত্র এই কেন্দ্রেই বর্তমান সাংসদ (অনুপ সাহা)-কে প্রার্থী করেনি সিপিএম। দলীয় সূত্রের খবর, গত পাঁচ বছর এলাকার কাজে তাঁকে পাওয়া যায়নি, এই যুক্তিতেই অনুপবাবুকে এ বার দাঁড় করানো হয়নি। কিন্তু ঈশ্বরবাবুর ভাবমূর্তি নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে জেলায়। ২০০৭ সালে কাটোয়ায় কংগ্রেস নেতা তুহিন সামন্তের হত্যাকাণ্ডে নাম জড়িয়েছিল ঈশ্বরবাবুর। বাম আমলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছিল। সেই মামলা এখনও চলছে। জামিনে রয়েছেন সিপিএম প্রার্থী।

চার্জশিটের প্রতিলিপি সঙ্গে নিয়ে মন্ত্রী স্বপনবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “তখন রাজ্যে কাদের সরকার ছিল? নির্বাচন কমিশনের আপত্তিতে দেওয়াল লিখন থেকে ‘খুনি’ শব্দটা মুছে দিয়েছি। কিন্তু মানুষের মন থেকে থেকে তা মোছা যাবে?” বিজেপি প্রার্থীর কটাক্ষ, “ভোটে জিতলেও আদালতে দোষী প্রমাণিত হলে তো ওঁকে জেলে যেতে হবে!” বিরোধীদের এই প্রচার যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেললেও অমলবাবুর দাবি, “এ সব মিথ্যা অভিযোগ। আমরা দলীয় স্তরে তদন্ত করে দেখেছি ঈশ্বরের কোনও দোষ নেই। তাই তাঁকে প্রার্থী করা হয়েছে।’’ কালনার দলীয় কার্যালয়ে বসে ঈশ্বরবাবুও বলছেন, “মামলা চলছে। ফয়সালা তো হবে আদালতে।”

কিন্তু বাম সরকারই তো তাঁকে চার্জশিট দিয়েছে? কথা থামিয়ে দিয়ে অমলবাবুর ব্যাখ্যা, “চার্জশিট দেওয়ার সময়ে আমরা পুলিশের উপর কোনও হস্তক্ষেপ করিনি।” কাটোয়া রামকৃষ্ণ বিদ্যামন্দিরের ইতিহাসের শিক্ষক ঈশ্বরবাবু বলছেন, “মন্ত্রী হলে তো সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়। বুদ্ধদেববাবুও তাই করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ সব মানেন না।”

সদ্য-দলত্যাগী আর খুনের মামলায় অভিযুক্ত দুই মূল প্রার্থীকে ঘিরে এই টানাটানির মধ্যেই সিঁদ কেটে ঢুকে পড়েছে বিজেপি। গত পঞ্চায়েত ভোটেও যাদের অস্তিত্ব নিয়ে কার্যত প্রশ্ন তুলত বিরোধীরা। মোদী-হাওয়ায় এ বার তাদের কপালেই চিন্তার ভাঁজ! জনসংযোগ বাড়াতে যাবতীয় কৌশল নিয়েছে বিজেপি। তাদের দাবি, পদ্মফুলে কৌতূহলও বাড়ছে মানুষের। আর এ সব দেখে বিজেপি প্রার্থী সন্তোষ রায় জেতা নিয়ে আরও আত্মবিশ্বাসী। মেমারির কাঠ ব্যবসায়ী সন্তোষবাবু কাটোয়ায় প্রচারে বেরোনোর আগে বললেন, “৮৫ শতাংশ বুথে নির্বাচন কমিটি করে ফেলেছি।” সিপিএমের কায়দায় দোকানে-বাড়িতে রসিদ কেটে চাঁদাও তুলছে বিজেপি। “এ বার অন্য রকম হবে”, দাবি প্রার্থীর।”

কী রকম হবে? পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে তাঁর ব্যাখ্যা, “১৯৭৭-এর ভোটে সিপিএমের পোস্টার মারার লোক ছিল না। ওরা জিতেছিল বড় ব্যবধানে।” উদাহরণ হিসেবে উঠে এলেন তৃণমূল নেত্রীও। সন্তোষবাবু মনে করালেন, দলের একমাত্র সাংসদ হিসেবে লড়াইয়ে নেমে ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে ১৯ জনকে সংসদে পাঠিয়েছিলেন মমতা। গত বিধানসভায় তাঁর কাছেই বামফ্রন্ট কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। “তাই আগের সব হিসেব ভুলে যান। মানুষ এক জায়গায় থেমে থাকে না” মন্তব্য বিজেপি প্রার্থীর।

মজাটা এখানেই। হাতের তেলোর মতো চেনা মানুষগুলো যে সত্যিই আর এক জায়গায় থেমে নেই, তাতে মোটামুটি সব দলই একমত। অমল হালদারের কথায়, “কালনা, পূর্বস্থলী, মেমারিতে ওদের প্রভাব বাড়ছে। তবে বেশিটাই তৃণমূলের ভোট কাটবে। আমাদের দুর্বল চেতনার লোকেরাও যাবে। এটা আটকাতে হবে। চেষ্টা করছি।” কাটোয়ার কংগ্রেস বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও বিজেপির প্রভাব বাড়ার কথা মানছেন।

তিন পুরুষ প্রার্থীর বিরুদ্ধে এই কেন্দ্রে লড়ছেন এক মহিলা। কংগ্রেসের চন্দনা মাঝি। কাটোয়া পুরসভার তিন বারের কাউন্সিলর চন্দনাদেবীকে অবশ্য তাঁর এলাকার বাইরে লোকে বিশেষ চেনে না। নিজেও জানেন সে কথা। বলছেন, “আমার সব রবিদা (রবীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়)। তাঁর পরিচয়েই আমার পরিচয়।”


ক্লিক করুন...

কাটোয়ার খাজুরদিহি এলাকার অদূরে মুসলিমপাড়ায় তখন সন্ধে নামছে। দূর থেকে ভেসে আসছে গাজনের বাজনার শব্দ। তাতে যেন চাপা পড়ে যাচ্ছে ‘কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিন’ স্লোগান।

জিতবেন? তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ স্বপনবাবু ভুরু নাচাচ্ছেন, “এক সময়ে সিপিএম বলত, তাদের প্রতীকে কলাগাছ দাঁড়ালেও জিতবে। এখন আমরা সে কথা বলছি। পঞ্চায়েত ভোটের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছি এ বারেও।” এতটা আত্মবিশ্বাস? স্বপনবাবুর গলা কঠিন হল, “যদি জিততে না পারি, মন্ত্রিপদ এবং গ্রামীণ জেলা সভাপতির পদ দু’টোর কোনওটাতেই থাকার নৈতিক দায়িত্ব আমার নেই।”

২০১১-র বিধানসভায় বর্ধমানের বাম দুর্গে ফাটল ধরিয়েছিল তৃণমূল-কংগ্রেস জোট। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে একা লড়ে সিপিএমের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দেয় তৃণমূল। পঞ্চায়েতে তৃণমূলের সেই ‘সাফল্য’কে অবশ্য কোনও নম্বর দিতে নারাজ বিরোধীরা। সিপিএমের অভিযোগ, ওটা ভোট হয়নি। বুথ থেকে গণনাকেন্দ্র দেদার লুঠ করেছে তৃণমূল। বিজেপি-কংগ্রেসও একসুর।

তবে এ বার সেটা হবে না হুঁশিয়ারি দিচ্ছে সিপিএম। অমলবাবুর কথায়, “পঞ্চায়েতে আমরা প্রতিবাদ করার কৌশল নিয়েছিলাম। এ বার প্রতিরোধ হবে। তবে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে। আমাদের ছেলেরা সদর্থক ভূমিকা নেবে।” জেলা পুলিশের খবর, ‘প্রতিরোধ’ শুরুও হয়ে গিয়েছে। প্রায় রোজই বিভিন্ন এলাকা থেকে তৃণমূল-সিপিএম সংঘর্ষের খবর আসতে শুরু করেছে জানাচ্ছেন জেলা পুলিশের এক কর্তা।

সব দেখেশুনে ভোটাররা বিশেষ মুখ খুলছেন না। গরমের বেলা গড়িয়ে দুপুরের রাস্তাঘাট যেমন সুনসান, মানুষও তেমনই নির্লিপ্ত, উদাসীন! ঘরের দরজায়, রাস্তাঘাটে প্রার্থী দেখলে সৌজন্যের খাতিরে কেউ হাত নাড়ছেন, কেউ মুচকি হাসছেন। কিন্তু ভোটারের নাড়ি বোঝে— সাধ্য কার!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন