পুড়ছে ট্রাক্টর।
বাবার সঙ্গে মোটরবাইকে চড়ে মামারবাড়ি যাচ্ছিল সাত বছরের দিপীকা। পথে আচমকা পিছন থেকে এক বালি ভর্তি ট্রাক্টরের ধাক্কায় রাস্তায় পড়ে জখম হয় সে। পরে উত্তেজিত জনতা আগুন লাগিয়ে দেয় ওই ট্রাক্টরে। মারধর করা হয় খালাসিকে। এমনকী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের রোষের মুখে পড়ে পুলিশও।
সোমবার সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ কাটোয়া শহর লাগোয়া পানুহাট বারোজীবী পল্লির কাছে দুর্ঘটনাটি ঘটে। আগুন লাগা অবস্থায় ট্রাকটি রাস্তা জুড়ে আটকে থাকায় প্রায় আড়াই ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে দমকলের একটি ইঞ্জিন গিয়ে আগুন নেভায়। পুলিশ ওই গাড়ির খালাসি ময়ূখ শেখতে গ্রেফতার করেছে তবে চালক পলাতক।
ওই এলাকার যান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে বহু দিন ধরেই ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। এমনকী গত কয়েক মাসে বালির গাড়ির ধাক্কায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে এক ছাত্রেরও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকালে বাবার সঙ্গে মোটরবাইকে চেপে মামারবাড়ি যাচ্ছিল বছর সাতেকের দিপীকা ঘোষ। কাটোয়া-দাঁইহাট রোডের পানুহাট ইঁদারাপার থেকে কিছুটা দূরে বারোজীবী পল্লীর কাছে বালি ভর্তি একটি ট্রাক্টরের ট্রলি মোটরবাইকে ধাক্কা মারে। বাইক থেকে রাস্তায় ছিটকে পড়ে ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে যায় দিপীকা। আশপাশ থেকে লোকজন জড়ো হয়ে সঙ্গেসঙ্গেই তাকে প্রথমে কাটোয়া মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় তাকে। জখম দিপীকার বাবা, কাটোয়া আখড়া গ্রামের বাসিন্দা তাপস ঘোষ বলেন, “কাটোয়া এসেছিলাম। সেখান থেকে দিপীকার মামার বাড়ি দাঁইহাটের বেড়া গ্রামে যাচ্ছিলাম। ট্রলি সমেত ওই ট্রাক্টরটি আমার পিছনেই আসছিল। আচমকা ট্রাক্টরের ইঞ্জিনটি এগিয়ে গেলেও ট্রলিটা বাইকে ধাক্কা মারে। তাতেই পড়ে যায় মেয়ে।” প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ওই বালির গাড়িটি দুলতে দুলতে এসে মোটরবাইকে ধাক্কা মারে। এরপরেই স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বালির গাড়িটিকে আটকে খালাসি ময়ূখ শেখকে মারধর করেন তাঁরা। পরে ট্রাক্টরটিতেও আগুন লাগিয়ে দেন। ঘটনার পরে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ করে দেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা।
শোকার্ত বাবা।
এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, সিঙ্গল লেনের এই রাস্তায় শুধু বালির গাড়ি নয়, সব ধরণের গাড়িই বেপরোয়া ভাবে যাতায়াত করে। তার উপর ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ, ফল বিক্রেতা, ভ্যান ও রিক্সা চালকেরা রাস্তা জবরদখল করে রাখে। এর জেরে গত কয়েকমাসে শুধুমাত্র এই এলাকায় বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে বলেও তাঁদের দাবি। এ দিনের ঘটনার পরে তাঁদের জমা ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। এলাকার দীপক দেবনাথ, শ্যামল দেবনাথেরা বলেন, “দিনের পর দিন বালির গাড়ির চালকদের জনবহুল এলাকায় নিয়ন্ত্রন রাখতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের কথা তো শোনা দূরের কথা, উল্টে আমাদের সঙ্গেই অভব্য আচরণ করত।”
দিপীকার মামারবাড়ি বেড়া এলাকাতে কয়েক মাস আগেই ট্রাক্টরের ধাক্কায় দিব্যেন্দু রায় নামে পঞ্চম শ্রেণির এক ছাত্র মারা যায়। জখম হয়েছিল আরও দুই ছাত্র। ওই দিন ওই তিন ছাত্র সাইকেলে করে স্কুল যাচ্ছিল। পথে ট্রলিসমেত একটি ট্রাক্টর সোজাসুজি তিনজনকে ধাক্কা মারে। ওই ঘটনার পরেও এলাকায় উত্তেজনা তৈরি হয়। ট্রাক্টরটির চালক ও খালাসিকে পুলিশ গ্রেফতার করে। তার কয়েকমাস পরে কাটোয়া শহর লাগোয়া বান্দরা গ্রামে অজয় নদের বাঁধে বালির গাড়ির ধাক্কায় জখম হয়েছিল কেতুগ্রামের কাঁকুরহাটি গ্রামের নবম শ্রেণির ছাত্র রঞ্জিত ঘোষ। ওই দিন সে ও তার কাকা সুজিত ঘোষ কাটোয়া শহরে গবাদিপশুর চিকিৎসা করিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে। দুর্ঘটনার পরেই স্থানীয় বাসিন্দারা গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর কিছুদিন পরে কাটোয়া শহরের এসটিকেকে রোডে বালি ভর্তি ডাম্পারের ধাক্কায় স্থানীয় বিবেকানন্দ পল্লীর বাসিন্দা সোহিনী মুখোপাধ্যায় নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই এলাকার রাস্তা সংকীর্ণ। তার উপর জবরদখল, বেপরোয়া গাড়ি চলাচল লেগেই থাকে। এমনকী বেশিরভাগ চালকদের লাইসেন্সও থাকে না। ফলে গাড়িতে ‘ওভার লোড’ থাকলে তা সামলানোর ক্ষমতা থাকে না চালকদের। এছাড়া বেশিরভাগ ট্রাক্টরে ন্যুনতম আলোর ব্যবস্থা থাকে না, ট্রাক্টরের সঙ্গে ট্রলি লাগানোরও কোনও অনুমতি থাকে না। ফলে দিনের পর দিন দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে ওই এলাকায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, কয়েক বছর আগেও মহকুমাশাসকের (কাটোয়া) নেতৃত্বে বালির গাড়ি ধরত প্রশাসন। তবে এখন সেই অভিযান বন্ধ রয়েছে। ফলে বালির গাড়িগুলির দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে।
বর্ধমান জেলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “ওই অভিযান শুরু করার পাশাপাশি দিনের ব্যস্ত সময়ে বালির গাড়ি চলাচল যাতে কাটোয়া ও দাঁইহাট শহর সংলগ্ন এলাকায় বন্ধ থাকে তার প্রস্তাব মহকুমা প্রশাসনকে দেওয়া হবে।”
কাটোয়ায় তোলা নিজস্ব চিত্র।