ব্যারাকপুরে নিস্তরঙ্গ শিল্পাঞ্চল জুড়ে আজ ভো-কাট্টার আনন্দ

মরচে ধরেছে লোহার যন্ত্রে। কারখানার দরজা খোলা থাকলেও উৎপাদনে বহু দিনই ভাটা। কোথাও আবার উৎপাদনই নেই। ধুঁকতে থাকা সেই শিল্পাঞ্চলেই আজ, শনিবার ‘ভো-কাট্টা’ চিৎকারে গমগম করবে কুলিলাইন পাড়া।

Advertisement

বিতান ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:১৬
Share:

মরচে ধরেছে লোহার যন্ত্রে। কারখানার দরজা খোলা থাকলেও উৎপাদনে বহু দিনই ভাটা। কোথাও আবার উৎপাদনই নেই। ধুঁকতে থাকা সেই শিল্পাঞ্চলেই আজ, শনিবার ‘ভো-কাট্টা’ চিৎকারে গমগম করবে কুলিলাইন পাড়া।

Advertisement

এক সময়ে বিশ্বকর্মা পুজো হতো ধুমধাম করে— দুর্গাপুজোর থেকেও বড় আয়োজনে শ্রমিকদের পরিবার মিলে খাওয়াদাওয়া, আড্ডা, নাটক। সে দিন গিয়েছে। ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে এখন বহু কারখানাই বন্ধ। অনেকেই পুজোর আয়োজন কমিয়েছেন খরচ সামলাতে না পেরে। বন্ধ টিটাগড় পেপার মিলের ভাটপাড়া ইউনিটে এলাকা থমথমে। শ্যামনগর নিক্কো কোম্পানিও ঝাঁপ বন্ধের আগে পর্যন্ত আতসবাজি পোড়াত। এ বার কোনও মতে পুজো। আগাছা সাফ করে, গঙ্গাজল দিয়ে গোবর লেপে ছোট্ট শামিয়ানার নীচে তৈরি হয়েছে মণ্ডপ। শিল্প ও সৃষ্টির দেবতা বিশ্বকর্মার আরাধনায় ছোট্ট করেই প্রস্তুতি সেরেছেন কারখানার শ্রমিকেরা। আশা একটাই, যদি কারখানা খোলে। যদি মেলে বকেয়া টাকা। এশিয়ার বৃহত্তম চটকল নৈহাটির হুকুমচাঁদেও বিশ্বকর্মা পুজো হচ্ছে এ ভাবেই। সিইও সমীরকুমার চন্দ্র বলেন, ‘‘পুজো যে না করলেই নয়। কিন্তু সেই উত্তেজনা কই?’’

তার মধ্যেই একটু আলো দেখায় কুলিলাইন পাড়ার আকাশ। বছরভরের সাদা-কালো-ধূসর দিনযাপনে একমুঠো রং ঢালে বিশ্বকর্মা পুজো। পেটকাটি-চাঁদিয়ালের সুতোয় ভর করে আকাশ ছোঁয় রংচঙে স্বপ্ন। মন্দার বাজারে এখন বছরে দু’বার ভিড় জমে। বিশ্বকর্মা পুজো ছাড়া সরস্বতী পুজোয়। পাঁচু সাউ, মানিক সাউরা তবু ব্যবসা থেকে সরতে চান না। এই দুই মরসুমের ভরা বাজারই জিইয়ে রেখেছে ব্যবসা। টিটাগড়ে পি কে বিশ্বাস রোডের ‘জে কাইট’, ‘কে কাইট’-এর মতো দোকানগুলোয় তাই মাটিতে ঘুড়ির ঝাঁক দলবেঁধে থাকে। ঘুড়ির দোকানের লাইন এঁকেবেঁকে এগোয় টিটাগড়ের অলিগলি ধরে। ঘুড়ি, সুতো, লাটাইয়ের জোগান দিতে হিমশিম দোকানগুলো।

Advertisement

গত বছর বাজার ছেয়ে গিয়েছিল জাম্বো ঘুড়ি। বিশাল এই ঘুড়ি যত উপরেই উঠুক, নজরে পড়বেই। পেটকাটি, চাঁদিয়াল, ভোমরা, একতে, দোতে-র রমরমা গিয়েছে। তার জায়গায় এখন হাজির প্লাস্টিক বা ফিনফিনে কাপড়ের রংবেরঙের ঘুড়ি। কার্টুন আর নায়ক-নায়িকাদের ছবি দেওয়া সেই ঘুড়ির চাহিদাও বেশি। মাঝ-আকাশে কেটে না গেলে এ সব ঘুড়ি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। কাঠের লাটাইয়ের বদলে ফাইবারের লাটাইয়ে এলইডি আলো। আলোর চমকদারি ঘুড়িতেও। পড়ন্ত বিকেলের আকাশে তা চোখ টানবে। এক সময়ে ইলেকট্রিকের পোস্টে সুতো বেঁধে আঠায় কাচের গুঁড়ো মাখিয়ে মাঞ্জা দেওয়া হতো। রেডিমেড মাঞ্জার যুগে তার জায়গা নিয়েছে নাইলন আর সিন্থেটিক সুতো। তবে সেই সুতোয় ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে ঘিঞ্জি শিল্পাঞ্চলে দুর্ঘটনা বাড়তে থাকায় এ বার ঘুড়ি ব্যবসায়ীরাই জোর দিচ্ছেন তুলোর সুতো বিক্রিতে।

নেই নেই করেও হাজার দুয়েক কারখানা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। এর মধ্যে ২১টি চটকল। টিটাগড় ওয়াগনের মতো ভারী শিল্পও টিটাগড়ে ব্যবসা সামলাতে হিমশিম। কারখানার পক্ষ থেকে সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শ্রমিক সমস্যা আছে। তার সঙ্গে রয়েছে বরাত পাওয়ার সমস্যাও। তবু আমরা টিঁকে থাকার লড়াই করছি। বিশ্বকর্মা পুজো হচ্ছে। কারণ এটা রীতি এবং অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।’’

বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিনই তাই আকাশ জুড়ে রঙের বাহার ব্যারাকপুরে। ঘুড়ির নেশায় মাতোয়ারা আট থেকে আশি। অশীতিপর সমীরকুমার ঘোষ নিজে ঘুড়ি উড়িয়েছেন মধ্যবয়স পর্যন্ত। বললেন, ‘‘কারখানাগুলো ধুঁকছে, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সারা বছর শ্রমিক পরিবারে মানুষগুলোর মুখ ম্লান। কিন্তু বিশ্বকর্মা পুজোর আকাশ বলে দেয় এখন সব কিছু সাদা-কালো হয়ে যায়নি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন