প্রকল্প প্রচারে নিজেই সিনেমা বানান বিডিও

প্রচারের নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছিলেন নিজেই। স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমা করে সার্বিক স্বাস্থ্যবিধানের প্রচার চালাতে চান চন্দ্রকোনা রোডের বিডিও। লিখলেন রূপশঙ্কর ভট্টাচার্যচন্দ্রকোনা রোড ব্লককে নির্মল ব্লক হিসেবে গড়ে তোলার গল্প শোনাচ্ছিলেন শুভঙ্কর বিশ্বাস। তিনিই গড়বেতা ৩ অর্থাৎ চন্দ্রকোনা রোড ব্লকের বিডিও।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৮ ০২:৩৩
Share:

চেষ্টা: আলোর দিশারীর ডিভিডি হাতে বিডিও। নিজস্ব চিত্র

কাজে যোগ দিয়ে ভারী অবাক হয়ে গিয়েছিলেন বিডিও। এলাকার ৯০ শতাংশ মানুষ খোলা জায়গায় প্রাতঃকৃত্য করেন। কারও কারও বাড়িতে শৌচালয় রয়েছে। তবুও তাঁরা বাইরে বিশেষ কাজ করতে যান। ব্লকের আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাতেই কম বেশি একই ছবি। চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন বিডিও। নির্মল গ্রাম গড়ার স্বপ্ন তো অনেক দূরের কথা। অভ্যাস বদল করতেই তো অনেক সময় চলে যাবে।

Advertisement

চন্দ্রকোনা রোড ব্লককে নির্মল ব্লক হিসেবে গড়ে তোলার গল্প শোনাচ্ছিলেন শুভঙ্কর বিশ্বাস। তিনিই গড়বেতা ৩ অর্থাৎ চন্দ্রকোনা রোড ব্লকের বিডিও। ২০১৫ সালের অগস্ট মাসে এই ব্লকের বিডিও হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি।

এমন অসাধ্যসাধন হল কী করে? শুভঙ্করবাবু জানালেন প্রার্থনা সভায় প্রচার থেকে নাটক, নানা পরিকল্পনা করেই এই সাফল্যের কাছে পৌঁছতে হয়েছে। তিনি ঠিক করে নিলেন, অভ্যাস বদলাতে হলে প্রথমে ঘরে ঢোকা উচিত। আর সেই ঘরের সদর দরজা হবে স্কুলগুলো। খুব সহজ হিসেবটা। ব্লকে রয়েছে ২৩৮টি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, ১৯টি হাইস্কুল, ১৭টি জুনিয়র হাই স্কুল, ১২টি প্রাথমিক স্কুল। এছাড়াও রয়েছে ৬২টি এসএসকে, আটটি এমএসকে, একটি এমসিএলপি। শুভঙ্করবাবু ঠিক করলেন, প্রতিটি স্কুলে তিনি সহকর্মীদের নিয়ে প্রচার করবেন। কারণ স্কুলের পড়ুয়াদের কানে বাইরে প্রাকৃতিক কাজের বিপদ সম্পর্কে তথ্য পৌঁছে দিতে পারলে কাজটা অর্ধেক হয়ে যায়। পড়ুয়াদের মাধ্যমে পৌঁছে যাওয়া যাবে অর্ধেক বাড়িতে।

Advertisement

পুজোর পরে শুরু করলেন প্রচার। প্রতিটি স্কুলের প্রার্থনা সভায় উপস্থিত হতে শুরু করলেন। সেখানেই শুরু হল প্রচার। কাজে এল পরিকল্পনা। ২০১৬ সালে বাইরে যাওয়ার কাজ কমে গেল অনেকটাই। প্রায় ৫০-৫০ শতাংশ। এর সঙ্গে ছিল নজরদার বাহিনী এবং অন্যান্য পরিকল্পনা। প্রথম পরিকল্পনা সফল হতেই বিডিও সাহেব ঝাঁপালেন অন্য পরিকল্পনায়। দৃশ্যমাধ্যমে প্রচার। নাটক লিখে সচেতনতার কথা জানাতে হবে মানুষকে। লেখালেখির অভ্যাসটা ছিলই। কলকাতার বেলঘরিয়ার বাসিন্দা তিনি। সরকারি চাকরি জীবন শুরু করেন ভূমি দফতরের আধিকারিক হিসেবে। সেখান থেকে ব্লক প্রশাসনের শীর্ষস্তরে। চন্দ্রকোনা রোডে বিডিও হয়ে আসার আগে দুর্গাপুর এসডিও অফিসের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে ছিলেন। চাকরির কারণে ঠাঁই নাড়া হয়েছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু লেখালেখিটা ছাড়েননি।

শুভঙ্করবাবু গত বছর লিখেছিলেন তাঁর দ্বিতীয় নাটক ‘আলোর দিশারী’। প্রথম নাটকটিও মঞ্চস্থও হয়েছিল কয়েকবার। ‘আলোর দিশারী’ নাটকের মূল বিষয়বস্তু মিশন নির্মল বাংলা। শৌচাগার নির্মাণ ও তার ব্যবহার করা যে কতটা প্রয়োজন সেটাই তুলে ধরেছেন নাট্যকার বিডিও। চন্দ্রকোনা রোড এলাকায় বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠান, মেলা, উৎসবে সেই নাটক মঞ্চস্থও তিনি করিয়ে ছিলেন ব্লক অফিসের সরকারি অফিসার এবং কর্মীদের দিয়েই। মানুষের সাড়া মিলেছিল প্রচুর। জনপ্রিয় এই নাটককেই এবার সিনেমায় রূপান্তর করেছেন তিনি। কাহিনী, চিত্রনাট্য, আবহ সুর, প্রযোজক, পরিচালক বিডিও স্বয়ং। অভিনয় করছেন ব্লক অফিসের সরকারি অফিসার-কর্মীরা। শ্যুটিং পর্ব শেষের পর সম্পাদনার কাজও শেষ হয়েছে।

নয়াবসত, সাতবাঁকুড়া এবং শঙ্করকাটার বিভিন্ন এলাকায় ১০-১৫ দিন ধরে শ্যুটিং করেছেন। তবে তার জন্য কাজে ফাঁকি দেননি। শনি এবং রবিবার ছুটির দিনে শ্যুটিংয়ের কাজ চলেছে। যে নাটক লিখে মানুষকে শৌচাগার নির্মাণের বার্তা দিয়েছিলেন, সেই লেখাতেই সংযোজন-বিয়োজন করে চিত্রনাট্য তৈরি করেন শুভঙ্করবাবু। তারপরই স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি তৈরির পরিকল্পনা।

ছবিতে অভিনয় করছেন যুগ্ম বিডিও শিলাদিত্য জানা, ব্লকের স্বসহায়ক দলের সুপারভাইজার জয়শঙ্কর তিওয়ারি, অফিসকর্মী অমিত দাস, সঞ্জয় দে, শান্তনু দণ্ডপাট, বনশ্রী, প্রিয়াঙ্কা, মন্দিরা-সহ অনেকেই। অভিনয় করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরাও। যাঁরা সরকারি অফিসের কাজে দক্ষ তাঁরা কীভাবে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করলেন? যুগ্ম বিডিও শিলাদিত্য জানা বলেন, ‘‘বিডিও সাহেব যেভাবে আমাদের উৎসাহ দিয়েছেন ভয়-অস্বস্তি উধাও হয়ে গিয়েছে।’’ অফিসকর্মী সঞ্জয় কুণ্ডুদের বক্তব্য, ‘‘শ্যুটিংয়ের আগে বিডিও সাহেব নিখুঁতভাবে সব কিছু বুঝিয়ে দিতেন। তারপর কয়েকবার টেক করার পর করতেন ফাইনাল টেক। ভুল হলে আবার ঠিক করিয়ে নিয়ে তিনি ফিল্মটিকে নিঁখুত করার চেষ্টা করেছেন।’’

এবার সেই ছবির ছাড়পত্র পাওয়ার পালা। ১৫ জুন জেলাশাসক জগদীশপ্রসাদ মিনার হাতে শুভঙ্করবাবু তুলে দিয়েছেন তাঁর মিশন নির্মল বাংলার উপর নির্মিত ৩০ মিনিটের ছবি ‘আলোর দিশারী’র ডিভিডি। জেলা প্রশাসনের অনুমোদন মিললেই ‘আলোর দিশারী’ জনসমক্ষে আসবে বলে জানালেন পরিচালক বিডিও। অবশ্য প্রাথমিক কাজ হয়ে গিয়েছে। তাঁর প্রচেষ্টায় ব্লক ও পঞ্চায়েত প্রশাসনের সার্বিক উদ্যোগে ‘নির্মল ব্লকের’ তকমা পায় গড়বেতা ৩ ব্লক।

স্বল্প দৈর্ঘ্যের সিনেমার কাহিনিটা কী? শুভঙ্কর বললেন, ‘‘খোলা জায়গায় শৌচকর্ম করলে কী কী রোগজীবাণু ছড়াতে পারে, সেটা তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে জানানো হয়েছে, এমন কাজে শাস্তি পেতে হতে পারে। ছবিতে থাকছে একেবারে মেঠো সুর আর অঞ্চল এবং চরিত্রভিত্তিক সংলাপ। ছবিরই একটি দৃশ্য। ভোর হচ্ছে। শোনা যাচ্ছে একই সঙ্গে আজান এবং হরিনাম সংকীর্তনের সুর।

অন্য ধরনের ভোর হোক আটটি গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের। সেটাই তো চেয়েছিলেন পরিচালক বিডিও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন