আক্রান্ত এক বিজেপি সমর্থক।
তখন বেলা ১১টা ২০ মিনিট। সময়টা মনে আছে, কারণ বিজেপির সিউড়ি জেলা দফতরে ঢোকার আগে ঘড়িটা দেখেছিলাম। বিজেপির জেলা দফতর থেকে সিউড়ি প্রশাসনিক ভবন মেরেকেটে ৩০০ মিটার। দূর থেকে দেখলাম, রাস্তায় আজ দ্বিগুণ ‘উন্নয়ন’। প্রথম দফায় মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রশাসনিক ভবনের বাইরে যত লোক দেখেছিলাম, আজ দেখলাম তার দ্বিগুণ সংখ্যক লোক। হাতে লাঠি। তাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাও অনেক। প্রায় সবার মুখই রুমালে ঢাকা। বিরোধীরা অবশ্য বলছে, এরা সকলেই শাসকদলের কর্মী-সমর্থক। এর মধ্যেই খবর এল, দুবরাজপুরে পঞ্চায়েত সমিতির প্রার্থী এক বিজেপি প্রার্থীকে মারধর করা হয়েছে। তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছে।
বিজেপির জেলা দফতরে তখন জেলা সভাপতি রামকৃষ্ণ রায় আলোচনা করছেন সাধারণ সম্পাদক কালোসোনা মণ্ডলের সঙ্গে। কী ভাবে প্রার্থীদের সঙ্গে নিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাওয়া হবে, চলছে তারই প্রস্তুতিপর্ব। বিজেপি অফিসে তখন দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে অনেক মহিলাও আছেন। আমার সঙ্গে আর এক জন সাংবাদিকও ছিলেন। এই সময়েই হামলা শুরু হল। দেখলাম, কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আর একটা ভিড় লাঠি উঁচিয়ে ইট ছুড়তে ছুড়তে বিজেপি অফিসের দিকে ছুটে আসছে। কয়েক জনের হাতে পিস্তলও রয়েছে, স্পষ্ট লক্ষ্য করলাম। পাল্টা প্রতিরোধ গড়তে বিজেপি কর্মীরাও দেখলাম ডান্ডা, মঞ্চ তৈরির কাঠের বাটাম হাতে ছুটে গেলেন হামলাকারীদের দিকে। দু’পক্ষই ইট ছুড়ছে, হাতের লাঠিরও যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে।
হামলার মাঝেই ছুটে বেরিয়ে আশ্রয় নিলাম কাছের একটি দোকানে। ভীত-সন্ত্রস্ত দোকানদার বললেন, ‘‘আপনার কি মনে হয়, এটা আশ্রয় নেওয়ার উপযুক্ত জায়গা?’’ কোনও কথা না বলে ক্যামেরা বার করলাম। যে ভাবেই হোক, এই সন্ত্রাস ফ্রেমবন্দি করতেই হবে।
সিউড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র, ইট, লাঠি নিয়ে তাণ্ডব।
ছবি তোলার মাঝেই খবর এল, শহর থেকে ২ কিলোমিটার দূরে সিউড়ি-১ নম্বর ব্লকে গন্ডগোল হতে পারে। সেখানেও বিজেপি প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসছেন। সহকর্মী চিত্রগ্রাহক তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই তাঁর মোটরবাইকে পৌঁছলাম সেখানে। তখন বাজে সওয়া ১২টা। সেখানেও রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘উন্নয়ন’। বিজেপির লোকজন সেখানে পৌঁছনো মাত্র দু’পক্ষে গন্ডগোল শুরু হয়ে গেল। চলল বোমাবাজি। মুহূর্মুহূ বোমা পড়ছে। কানফাটানো আওয়াজ। গোটা এলাকা ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। গুলিও চলে। এরই মধ্যে বিজেপি কর্মী শ্যামসুন্দর গড়াইয়ের হাতে গুলি লাগে।
আরও পড়ুন: নির্লজ্জ বেলাগাম সন্ত্রাস, বোমা-বন্দুক হাতে ঝাঁপাল শাসক, নিহত ৩
তবে দেখলাম, বিজেপির জোর ততটা নেই। তারা এলাকা ছেড়ে চম্পট দিয়েছে। এই গন্ডগোলের মধ্যে পড়ে যান তাপসদা ও আরও দুই সাংবাদিক। তাপসদার পায়ে আঘাত লাগে। প্রাণ বাঁচাতে তিনি একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। শুনলাম, আরও দুই সাংবাদিককে মাস্কেট দেখিয়ে কাছের একটা ঘরে নিয়ে গিয়েছে হামলাকারীরা।
দেখুন ভিডিও
বিজেপির লোকেরা তখন সরে যাচ্ছে। কড়িধ্যায় ব্লক অফিস থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মুখে রুমাল বাঁধা ভিড়টা। আমরা দুই সাংবাদিক অবশ্য ঘটনাস্থল ছেড়ে নড়িনি। কিন্তু এর পরের ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না একেবারেই। ভিড়ের চোখ পড়ল আমাদের দিকে। রে-রে করে বোমা হাতে ছুটে এল কয়েক জন। আমরা প্রাণভয়ে দৌড়তে শুরু করলাম। হঠাৎ কানফাটানো আওয়াজ। আমাদের পিছনে ফুট বিশেক দূরে বোমাটা ফাটল। ধোঁয়ায় ভরে গেল চার দিক। আর একটু কাছে পড়লেই বোমার সপ্লিন্টার যে কোথায় ঢুকত কে জানে! আমরা তখন কত জোরে দৌড়চ্ছি সে খেয়ালও নেই।
আরও পড়ুন: পঞ্চায়েত নিয়ে ফের হাইকোর্টে বিরোধীরা, মামলা উঠবে কাল
দৌড়তে দৌড়তেই কড়িধ্যায় একটা বাড়িতে ঢুকে পড়লাম। বাড়ির মহিলারা আমাদের অবস্থা দেখে বললেন, জুতো পরেই ভিতরে চলে আসতে। আমরা ঢোকার পরেই বন্ধ হয়ে গেল বাইরের দরজা। একটু ধাতস্থ হয়ে দেখলাম, সিঁড়ির নীচে মাথা নিচু করে ভয়ে কাঁপছেন বিজেপির চার মহিলা প্রার্থী। তাঁরাও মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন। বাইরে তখন প্রবল দাপাদাপির আওয়াজ। চিৎকার-জুতোর আওয়াজ-কারা যেন কাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আধ ঘণ্টাটাক এই অবস্থা চলার পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক বলে মনে হল। খুব ভয়ে ভয়ে বাড়ির এক মহিলা বাইরের দরজা খুললেন। সে বাড়িও পুরুষশূন্য। এরই মধ্যে শুনলাম, গন্ডগোলে দিলদার খান নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তাঁর বাড়ি সিউড়ি থানা এলাকারই ছোরা ভাটিপাড়ায়। তবে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় সোমবার বিকেল পর্যন্ত স্পষ্ট নয়। দু’দলেরই দাবি, নিহত তাদের সমর্থক।
আরও পড়ুন: রাজ্য জুড়ে তীব্র সন্ত্রাস, আক্রান্ত বিধায়ক, সাংসদ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও
বীরভূমে বিরোধী প্রার্থীদের মনোনয়নে যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য সিউড়ির তৃণমূল অফিসে হাজির থাকার কথা জানিয়েছিলেন জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। দিনভর এ রকম হামলার কথা ‘কেষ্টদা’র কানে পৌঁছেছে কি না তা অবশ্য এখনও জানা হয়নি তাঁর কাছে!