West Bengal News

নীরব অভিযান ‘ভাইপো’র কেন্দ্রে, ৯৩% আসনে প্রার্থীই নেই বিরোধীদের

বীরভূমের ছবি নিয়ে যথেষ্টই সমালোচনা হয়েছে। অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে বল্গাহীন সন্ত্রাস কায়েম করার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। কিন্তু কলকাতা লাগোয়া জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও যে নীরবে একই ছবি তৈরি হয়ে গিয়েছে, শুরুতে তা বোঝা যায়নি।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৮ ১৪:৫৫
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

দুই ভারিক্কি নেতা। দু’জনেই দলনেত্রীর অত্যন্ত কাছের। দু’জনের এলাকাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছেন বিরোধীরা। কিন্তু একজনকে ঘিরে বেজায় হইচই হয়েছে রাজ্য জুড়ে। আর এক জনের এলাকায় প্রায় নিঃশব্দে কাজ সেরে ফেলেছে শাসক দল।

Advertisement

প্রথম জনের নাম অনুব্রত মণ্ডল, তৃণমূলনেত্রীর অত্যন্ত প্রিয় কেষ্ট। দ্বিতীয় জনের নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখ্যমন্ত্রীর অসীম স্নেহের ভাইপো।

Advertisement

মনোনয়ন জমা দেওয়া শেষ হতেই জানা গিয়েছিল, অনুব্রত মণ্ডলের জেলা বীরভূমে তৃণমূলের নিরঙ্কুশ দখল কায়েম হয়ে গিয়েছে। জেলা পরিষদের ৪২টি আসনের মধ্যে ৪১টি-ই তৃণমূলের দখলে যাওয়া নিশ্চিত ছিল সে সময়ে। প্রত্যাহার পর্ব শুরু হতেই রাজনগর এলাকা থেকে জেলা পরিষদে মনোনয়ন দাখিল করা একমাত্র বিজেপি প্রার্থী মনোনয়ন তুলে নেওয়ার আবেদন জমা দেন। দিদির প্রিয় কেষ্ট নিশ্চিত করে ফেলেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জেলা পরিষদ বিরোধীশূন্য। গ্রাম পঞ্চায়েত এবং পঞ্চায়েত সমিতি স্তরেও ছবিটা প্রায় একই রকম হয়ে দাঁড়ায় (মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্ট ই-মনোনয়নকে গ্রাহ্য হিসেবে রায় দেওয়ার পরে অবশ্য পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে)।

বীরভূমের এই ছবি নিয়ে যথেষ্টই সমালোচনা হয়েছে। অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে বল্গাহীন সন্ত্রাস কায়েম করার অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। কিন্তু কলকাতা লাগোয়া জেলা দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাতেও যে নীরবে একই ছবি তৈরি হয়ে গিয়েছে, শুরুতে তা বোঝা যায়নি। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী ক্ষেত্র ডায়মন্ড হারবারে পঞ্চায়েতের তিনটি স্তর মিলিয়ে ৯৩ শতাংশেরও বেশি আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করা নিশ্চিত করে ফেলে তৃণমূল। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্ট ই-মনোনয়ন সংক্রান্ত যে রায় দিয়েছে, তাতে অবশ্য পরিস্থিতি কিছুটা বদলাতে পারে।

মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর কেন্দ্রে পঞ্চায়েতি লড়াইয়ের চেহারাটা কী রকম? দেখে নেওয়া যাক এক ঝলকে।

ডায়মন্ড হারবারে মোট গ্রাম পঞ্চায়েত ৭২টি। আসনসংখ্যা— ১০৮১। তার মধ্যে ১০০৬টি আসনে তৃণমূল ছাড়া কারও প্রার্থী নেই। ফলে ৭২টির মধ্যে ৬৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করা নিশ্চিত করে ফেলে তৃণমূল।

ডায়মন্ড হারবারে পঞ্চায়েত সমিতির মোট আসনসংখ্যা ২০৮। ১৯৭টি আসনে বিরোধী প্রার্থী নেই।

আর জেলা পরিষদ আসন ২০টি। কোনও আসনেই বিরোধী প্রার্থী নেই। অর্থাৎ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী ক্ষেত্রের অন্তর্গত জেলা পরিষদ আসনগুলির একটিতেও ভোট নেই।

এ প্রসঙ্গে কী বলছে তৃণমূল? প্রথমে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল খোদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেই। কিন্তু তাঁর অফিস থেকে জানানো হয়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনী প্রচারে ব্যস্ত রয়েছেন, তিনি কথা বলতে পারবেন না। এর পরে যোগাযোগ করা হয় তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘‘আমি হিসেবটা এখনও দেখিনি। না দেখে কিছু বলতে পারব না।’’ আর তৃণমূলের তরফে দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এ বার ‘ভোট ম্যানেজার’ যিনি, সেই রাজ্যসভা সাংসদ শুভাশিস চক্রবর্তী বললেন, ‘‘গত লোকসভা ভোটের পর থেকে ডায়মন্ড হারবারে আমাদের সংগঠনটা এতই শক্তিশালী হয়েছে, যে বিরোধীরা মাথাই তুলতে পারেন না। সংগঠন এবং উন্নয়ন, এর সামনে দাঁড়াতে পারছেন না বিরোধীরা। কেউ তো আর জেনেশুনে হারার জন্য ভোটে দাঁড়ান না। তাই বিরোধীরা প্রার্থী দেননি।’’

বিরোধীদের সংগঠন বা জনসমর্থন নেই বলে যে দাবি তৃণমূল করছে, তার সত্যতা কতটা? বিরোধী দলগুলো বলছে, গত কয়েক বছরে যে সব নির্বাচন হয়েছে, তার ফলাফলের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে, তৃণমূলের দাবি কতটা ভিত্তিহীন। সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বললেন, ‘‘২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ডায়মন্ড হারবারে তৃণমূল পেয়েছিল ৫ লক্ষ ৮ হাজার ৪৮১টি ভোট। আর বিরোধীদের সম্মিলিত ভোট ছিল ৭ লক্ষ ১ হাজার ৮৮। এর মধ্যে নোটা ও অন্যান্য নির্দল প্রার্থীদের ভোট ধরা নেই।’’ তিনি আরও বললেন, ‘‘২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে দেখা গিয়েছে, ডায়মন্ডহারবার লোকসভার অন্তর্গত ৭টি বিধানসভা কেন্দ্রে তৃণমূল মোট ৬ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯৯৬টি ভোট পেয়েছে। আর বিরোধীদের সম্মিলিত ভোট ছিল ৬ লক্ষ ৭২ হাজার ৩১। এর মধ্যেও নোটা ধরা নেই।’’ শমীকবাবুর প্রশ্ন, ‘‘যে এলাকা ২০১৪ সালে এবং ২০১৬ সালে সম্মিলিত বিরোধী ভোটের চেয়ে কম ভোট পেল তৃণমূল, এ বারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই এলাকার ৯৩.০৬ শতাংশ আসনে বিরোধীরা কোনও প্রার্থীই দিতে পারলেন না? কোন জাদুতে এটা সম্ভব হয় বলতে পারবেন?’’

শুভাশিস চক্রবর্তী অবশ্য শমীক লাহিড়ীর দেওয়া এই হিসেব নস্যাৎ করছেন। তিনি বলছেন, ‘‘সম্মিলিত বিরোধী ভোট বলে আবার কিছু হয় নাকি? তা হলে ভারতে কোনও দিন কংগ্রেস বা বিজেপি ক্ষমতায় আসতে পারত না। প্রত্যেক নির্বাচনেই জয়ী দলের চেয়ে বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত ভোট বেশি থাকে। বিরোধী ভোট কখনও এক হয় না। কংগ্রেস-সিপিএম-বিজেপির ভোট এক জায়গায় তো আর পড়বে না।’’

শুভাশিস যা-ই বলুন, বিরোধীদের দাবি, অনুব্রতর বীরভূমের মতো অভিষেকের ডায়মন্ড হারবারেও বল্গাহীন সন্ত্রাস চালানো হয়েছে। পুলিশ-প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে শাসক দল বিরোধীদের উপরে হামলা চালিয়েছে বলে তাঁদের অভিযোগ। সিপিএমের জেলা সম্পাদকের কণ্ঠে বিস্ময়— ‘‘বিরোধী দলের প্রার্থীর মনোনয়ন জমা দওয়া আটকাতে প্রার্থীদের লক্ষ্য করে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে! দেখেছেন কখনও এমন দৃশ্য! আমাদের সাড়ে তিনশো থেকে চারশো প্রার্থীর বিরুদ্ধেএকাধিক ধারায় মামলা দিয়েছে। সাত থেকে দশ জনকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে।’’

বিজেপির গলায়ও একই সুর। রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র সায়ন্তন বসুর কথায়, ‘‘মনোনয়ন জমা নেওয়া যখন চলছিল, তখন আলিপুরের প্রশাসনিক ভবনের অবস্থাটা কেমন ছিল, সে আর কারও জানতে বাকি নেই। প্রশাসনিক কর্তাদের চেম্বার দুষ্কৃতীদের দখলে চলে গিয়েছিল। সাংবাদিকদের মারধর করা হয়েছিল, বিবস্ত্র করে দেওয়া হয়েছিল, মহিলা সাংবাদিককে অপহরণ করা হয়েছিল।’’

কিন্তু ডায়মন্ড হারবার থেকে যে বিরোধীদের মুছে দেওয়া হচ্ছে, সে অভিযোগ মনোনয়ন চলাকালীন তোলা হল না কেন? বীরভূমের অবস্থা নিয়ে তো তোলপাড় হয়েছে গোটা রাজ্য, ডায়মন্ড হারবারে এত নীরবে সব হল কী ভাবে? ডায়মন্ড হারবারের প্রাক্তন সাংসদ শমীক লাহিড়ীর জবাব, ‘‘ওটা তো অনুব্রত মণ্ডল। ওঁকে নিয়ে হইচই করা যায়। কিন্তু ডায়মন্ড হারবারে তো খোদ পিসি-ভাইপোর ব্যাপার। কাউকে হইচই করতে দেওয়াই হয়নি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন