এই গোপীনাথ জিউ মন্দির সংস্কার করেই শুরু হবে পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কাজ। ছবি: সুব্রত জানা।
রয়েছে কয়েকশো বছরের দু’টি জীর্ণ মন্দির। একটি পুকুর। আর ইতিহাস।
উদয়নারায়ণপুরের গড় ভবানীপুরের রায় রাজবংশ এবং সেই বংশের রানি ভবশঙ্করীর কথা এখনও এলাকার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেই ইতিহাসকেই বহু মানুষের সামনে হাজির করতে গড় ভবানীপুরকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়তে উদ্যোগী হয়েছে হাওড়া জেলা পরিষদ।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই গোপীনাথ জিউ মন্দির এবং মণিনাথ জিউ মন্দিরে যাওয়ার মূল রাস্তার উপরে তোরণ নির্মাণের কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। সেই তোরণে রাজবংশের নানা গৌরবময় এবং ঐতিহাসিক মুহূর্তের ছবি ও বর্ণনা চিত্রিত থাকবে। তৈরি করা হবে একটি টিকিট কাউন্টার, শৌচালয়, পার্ক, বিশ্রামাগার, কমিউনিটি হল। থাকবে পানীয় জলের ব্যবস্থাও। স্থানীয় পাঠাগারটিতে জাদুঘর করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
জেলা পরিষদের তরফে গোটা প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন বন ও ভূমি কর্মাধ্যক্ষ মানস বসু। তিনি জানান, গোটা প্রকল্পটিতে ব্যবহার করা হবে সাংসদ তহবিলের টাকাও। জেলা পরিষদ খরচ করবে ৯ লক্ষ টাকা। সেই টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এ ছাড়া ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া রাজপ্রাসাদ চত্বরে সাংসদ তহবিলের ২৫ লক্ষ টাকায় একটি পার্ক তৈরি এবং সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনা রয়েছে। সাংসদ সুলতান আহমেদ এ ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছেন জানিয়ে মানসবাবু বলেন, ‘‘রানি ভবশঙ্করীর স্মৃতিধন্য এই এলাকাটিকে সার্কিট ট্যুরিজমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আগামী দিনে আরও উন্নতি করা হবে। বিস্তারিত প্রকল্প রিপোর্ট (ডিপিআর) তৈরির কাজ চলছে।’’ সাংসদও জানান, এলাকাটিতে পর্যটনকেন্দ্র গড়ার চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন চর্চা করছেন, এলাকার তেমনই কয়েক জন প্রবীণ মানুষ জানান, ৭০০ বছর আগে গড় ভবানীপুর ছিল ভুরসুট পরগনার রাজধানী। এখানে রায় বংশের প্রতিষ্ঠা করেন রাজা চতুরানন মহানিয়োগী। এই বংশের রাজা রুদ্রনারায়ণের মৃত্যুর পরে তাঁর স্ত্রী রানি ভবশঙ্করী ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। সেই সময়ে দিল্লির সম্রাট ছিলেন আকবর। কলিঙ্গের পাঠান শাসক কোতলু খাঁর সেনাপতি ওসমান খাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করেন রানি ভবশঙ্করী। আকবর রানিকে রায়বাঘিনি উপাধিতে ভূষিত করেন। এখানে ছিল প্রাসাদ, মন্দির, দুর্গ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সংরক্ষণের অভাবে সবই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।
রাজপ্রাসাদের জায়গায় এখন রয়েছে কিছু ঢিবি। আগাছায় ঢাকা গোপীনাথ জিউ মন্দিরের এখন জীর্ণ দশা। তিনটি পুকুরের মধ্যে ফুলপুকুরটি ঠিক রয়েছে। কিন্তু সংস্কারের অভাবে মজে গিয়েছে গড়পুকুর। আর ঘটপুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে বহু দিন আগেই। ২০১০ সালে মন্দির সংলগ্ন এলাকায় খননকার্য চালিয়ে কিছু প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার করেছিল রাজ্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
উদয়নারায়ণপুর কলেজের শিক্ষক তথা স্থানীয় বাসিন্দা সুখেন চন্দ্র ‘ভবশঙ্করী স্মৃতিরক্ষা সমিতি’র সম্পাদকও। তাঁর কথায়, ‘‘পরিকল্পনা রূপায়ণ হলে এলাকার ইতিহাস উদ্ধার করা সম্ভব হবে। গৌরব বাড়বে এলাকার।’’
উদয়নারায়ণপুর পঞ্চায়েত সমিতি অবশ্য আগেই মন্দির এবং রাজপ্রাসাদ সংলগ্ন এলাকার সৌন্দর্যায়নে উদ্যোগী হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সোনাতলা গ্রাম পঞ্চায়েতও ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে এলাকার রাস্তাঘাটের উন্নতি করেছে। সেই সঙ্গে গোপীনাথ জিউ মন্দির সংস্কার ও এলাকায় খননকার্য চালিয়ে আরও প্রত্নসামগ্রী উদ্ধার এবং উন্নয়নের জন্য স্থানীয় বিধায়ক, জেলা প্রশাসন এবং রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে পঞ্চায়েত সূত্রে জানানো হয়েছে।
পঞ্চায়েত প্রধান ধর্মদাস দলুই বলেন, ‘‘রাজ্য পর্যটন বিভাগ, জেলা পরিষদ ও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এলাকায় পর্যটনের প্রসারের জন্য আরও চেষ্টা করছি।’’ স্থানীয় বিধায়ক সমীর পাঁজা বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় ঐতিহাসিক জায়গাটি আজ মৃতপ্রায়। আমরা এলাকাটিকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।’’
এলাকার বাসিন্দারা মনে করছেন, এই উদ্যোগে আবার বহু মানুষের আনাগোনা বাড়বে গড় ভবানীপুরে। ঘটবে পর্যটনের প্রসার। তাঁদের মধ্যে দুলাল দত্ত বলেন, ‘‘পুরনো সংস্কৃতির পুনরুদ্ধার হবে শুনে ভাল লাগছে। মানুষের যাতায়াত আরও বাড়বে।’’ সোফিয়ার রহমান নামে আর এক বাসিন্দা বলেন, ‘‘এই জায়গা আমাদের গর্ব। জায়গাটিকে নতুন করে সাজানো হলে এখানে অর্থনৈতিক বিকাশও ঘটবে।’’ একই বক্তব্য আরও অনেকের।