তুলনা কমিশনে

বিহার সফল সদিচ্ছারই জোরে, বাংলা সেই আঁধারে

গোটা বিহার পারে। অথচ খাস কলকাতা পারে না! কেন পারে না, তার উত্তরটা বুঝি লুকিয়ে আছে দু’রাজ্যের শাসকের মনোভাবের মধ্যেই। অন্তত জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অন্দরে এমনই ধারণা দানা বেঁধেছে।

Advertisement

অনমিত্র সেনগুপ্ত

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:৪৫
Share:

গোটা বিহার পারে। অথচ খাস কলকাতা পারে না!

Advertisement

কেন পারে না, তার উত্তরটা বুঝি লুকিয়ে আছে দু’রাজ্যের শাসকের মনোভাবের মধ্যেই। অন্তত জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অন্দরে এমনই ধারণা দানা বেঁধেছে।

হানাহানি ও নির্বাচনী সন্ত্রাস রুখে বিহারে রক্তপাতহীন ভোট করিয়ে কমিশন এ বার কার্যত নজির সৃষ্টি করেছে। সে জায়গায় মাসখানেক আগে কলকাতা লাগোয়া সল্টলেক বা বালির পুরভোটে সন্ত্রাসের লাগামছাড়া চেহারা প্রকট হয়েছে সারা দেশের সামনে। এতে অশনি সঙ্কেত দেখেছে নির্বাচন কমিশন, যে কারণে বিহারের ভোটপর্ব চলাকালীনই তারা তড়িঘড়ি পশ্চিমবঙ্গ-পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে দেয়।

Advertisement

আগামী বছরের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভিন্ন ভোটে এখানে যে ভাবে হিংসার বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে, তাতে কমিশন যথেষ্ট উদ্বিগ্ন। বিশেষত কলকাতার ‘অভিজাত’ উপনগরী সল্টলেকের পুরভোটে সন্ত্রাসের ছবিটা উদ্বেগের আগুনে ঘি ঢেলেছে। বাংলায় নির্বিঘ্নে বিধানসভা ভোট আয়োজনের লক্ষ্যে এখন থেকেই কমিশন কোমর বাঁধছে।

পঞ্চায়েত বা পুরভোটে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের সরাসরি ভূমিকা না-থাকলেও বিধানসভা ও লোকসভা ভোট আয়োজনের সার্বিক দায়িত্ব তাদেরই। এবং সেই সুবাদে ভোটের সময় প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধা সেনা পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন করার জন্য ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের কাছে দরবার করেছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার নসীম জৈদী। পর্যাপ্ত আধা সেনা পেলেই কি শান্তিতে নির্বাচন করা সম্ভব?

কমিশন-কর্তারা বলছেন, মোটেই না। রাজ্য সরকারের সদিচ্ছাটা সবার আগে দরকার। এবং এ প্রসঙ্গেই উঠে আসছে বিহারের নাম। কী রকম?

কমিশন-সূত্রের বক্তব্য: একটা সময়ে বিহারের ভোট মানেই ছিল হানাহানি, খুনোখুনি, গা-জোয়ারি, বুথ দখল। নির্বাচন কমিশনার হিসেবে টি এন শেষন ও কে জে রাওয়ের সদর্থক ভূমিকা, আর নীতীশকুমারের গত দশ বছরের শাসন পরিস্থিতি অনেকটা পাল্টে দিয়েছে। ‘‘২০০৬-এ বিহারে পঞ্চায়েত ভোট হল। প্রথম দফায় ব্যাপক সংঘর্ষে বহু লোক মরল। দ্বিতীয় দফা থেকে সব ঠান্ডা। কারণ, প্রশাসনকে কড়া হওয়ার বার্তা দিয়েছিলেন নীতীশ।’’— স্মৃতিচারণ করছেন এক কমিশন-কর্তা।

কমিশনের অন্দরের পর্যবেক্ষণ, এই ধারাটা বিহারে গত এক দশক ধরে বহাল রয়েছে। এ বার যে শান্তির বাতাবরণে বিহারে ভোট হল, তা এক কথায় অভূতপূর্ব। যার পিছনে বিহার সরকারের ইতিবাচক ভূমিকার কথাই সর্বাগ্রে উল্লেখ করছেন কমিশনের অফিসারেরা। পিঠোপিঠি উঠে আসছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সদিচ্ছার অভাবের’ প্রসঙ্গও। কমিশনের বক্তব্য: ভোটের দিন ডিএম থেকে এসপি— সকলে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে তবেই অশান্তি আটকানো সম্ভব। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রশাসনের সিংহভাগ শাসকদলের অঙ্গুলিহেলনে কাজ করছেন, অথবা তাদের পঙ্গু করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ।

দু’রাজ্যের শাসকশিবিরের আচরণকেও চাপানো হচ্ছে তুলনার দাঁড়িপাল্লায়। বিহারে বিধানসভা নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই কমিশন বদলি করে দিয়েছিল নীতীশ-প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ আমলাকে। নীতীশ কমিশনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে টুঁ-শব্দটি করেননি। সে জায়গায় গত লোকসভা নির্বাচনের মুখে কমিশন পশ্চিমবঙ্গের কিছু আমলাকে সরিয়ে দিতেই প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোট শেষ হতে ওই অফিসারদের পুরনো পদে ফিরিয়ে আনতেও দেরি করেননি। কমিশনের এক আধিকারিকের আক্ষেপ, ‘‘প্রশাসনের শীর্ষ স্তরেই যদি এ ধরনের মনোভাব থাকে, তা হলে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে কী করে?’’

বস্তুত পূর্বতন বাম সরকার হোক বা বর্তমানের তৃণমূল— ভোটের দিনে কেন্দ্রীয় আধা ফৌজকে কার্যত বসিয়ে রাখার অভিযোগ বাংলার শাসকদের বিরুদ্ধে বহু পুরনো। কমিশনের অভিজ্ঞতা বলছে, অধিকাংশ সময়ে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে শুধু বুথে বসিয়ে দেওয়া হয়। অথচ বহু জায়গায় শাসকদলের শাসানির মুখে ভোটারেরা হয়তো বাড়ি থেকেই বার হতে পারেন না। কিংবা বার হলেও দুষ্কৃতীবাহিনীর ‘বেড়া’ টপকে বুথের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারেন না। আবার অনেক সংবেদনশীল এলাকায় কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দিয়ে ফ্ল্যাগ মার্চ করানোর দরকার থাকলেও জওয়ানদের দেওয়া হয় বুথে দাঁড়িয়ে লাইন সামলানোর দায়িত্ব। ‘‘ফলে আধা ফৌজ তলবের উদ্দেশ্যটাই আখেরে মাঠে মারা যাচ্ছে।’’— মন্তব্য করেছেন কমিশনের এক শীর্ষ কর্তা।

এই ছবিটাই তাঁরা এ বার পাল্টাতে চাইছেন। ওঁদের প্রাথমিক পরিকল্পনা, ভোটের আগে আধা সেনাকে বুথের গণ্ডি ছাপিয়ে বাইরে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। স্থানীয় তথ্যের ভিত্তিতে তাদের দিয়ে ফ্ল্যাগ মার্চ বা টহলদারি চালানো হবে। প্রয়োজনে কেন্দ্রের অনুমতি নিয়ে এক-দু’দিন আগে স্পর্শকাতর এলাকাগুলোয় বাহিনী মোতায়েন করার কথাও কমিশনের মাথায় আছে।

সব মিলিয়ে বাংলার ভোট-মাটিতে বিহারের নজিরকে ফিরিয়ে আনাটাই আপাতত কমিশনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন