’দিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। —নিজস্ব চিত্র।
লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলায় সর্বাত্মক লড়াইয়ের প্রস্তুতি। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনে যে কোনও মূল্যে বাংলার দখল নেওয়া। এবং সেই লক্ষ্য পূরণে এই মুহূর্ত থেকে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। বাংলা সফরের প্রথম দিনে রাজ্য বিজেপি-কে এই বার্তাই দিলেন অমিত শাহ। পোর্ট গেস্ট হাউসে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির বৈঠকে সাফ জানালেন, কোনও কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্ন নেই, তাই সরাসরি সঙ্ঘাতের প্রস্তুতি নিক দল। ২০১৯-এর কথা মাথায় রেখে বিদ্বজ্জনদের সভা থেকে অমিত শাহ সুর চড়ালেন কংগ্রেসের বিরুদ্ধেও। ‘তোষণ নীতি’ নিয়ে তীব্র আক্রমণ করলেন দেশের প্রধান বিরোধী শক্তিকে।
দু’দিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ। প্রথম দিনের ঠাসা কর্মসূচিতেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, আগামী কয়েক বছর এ রাজ্যে নিজের দলকে নিশ্বাস ছাড়ার ফুরসতটাও দিতে চান না তিনি।
উড়ানে দেরির জেরে নির্ধারিত সময়ের অন্তত এক ঘণ্টা পরে বুধবার কলকাতায় পৌঁছন অমিত শাহ। কিন্তু অমিত শাহ বিমানবন্দরে থাকাকালীনই বিজেপি সূত্রে জানানো হয়, কোনও কর্মসূচি বাতিল হচ্ছে না। নির্ধারিত সব কর্মসূচিতেই অংশ নেবেন জাতীয় সভাপতি।
রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়-সহ বঙ্গ বিজেপির নেতাদের সঙ্গে পোর্ট গেস্ট হাউসে বৈঠকে অমিত শাহ।
বিমানবন্দর থেকে পোর্ট গেস্ট হাউসে গিয়ে প্রথমে মধ্যাহ্নভোজ সারেন অমিত। তার পরেই শুরু করেন দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই কর্মসূচির প্রথমটি— নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির (ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট কমিটি) সঙ্গে বৈঠক। সে বৈঠকে রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, জাতীয় সম্পাদক রাহুল সিংহ, মুকুল রায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়, শমীক ভট্টাচার্য, সায়ন্তন বসু-সহ রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির সব মুখই হাজির ছিলেন। বাংলায় রাজনৈতিক লড়াই প্রসঙ্গে ওই বৈঠকেই অমিত শাহ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তাটি দিয়েছেন।
আরও পড়ুন: ‘বন্দে মাতরম্’ ভাঙল বলেই দেশভাগ, তত্ত্ব অমিতের
প্রাক্তন বিধায়ক তথা দলের অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘বিজেপিকে এ রাজ্যে সর্বশক্তি দিয়ে ময়দানে নামতে বলেছেন অমিত শাহ। দলকে সন্ত্রাসের মুখোমুখি যে হতে হচ্ছে, তা তিনি জানেন। কিন্তু অমিতজির স্পষ্ট বার্তা, সন্ত্রাস-সন্ত্রাস বলে ঘরে বসে থাকলে চলবে না। সর্বত্র সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরাসরি সংগ্রামে নামতে হবে।’’ তৃণমূলকে কোনও অজুহাতেই এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া নয়, অমিত শাহের বার্তা এক কথায় এই। জানিয়েছেন শমীক।
রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরের একাংশে জল্পনা রয়েছে যে, সামনে বিজেপি এবং তৃণমূল পরস্পরের তীব্র বিরোধিতা করলেও, ভিতরে ভিতরে সমঝোতার পথও খোলা রাখা হচ্ছে। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না পেলে বাজপেয়ী জমানার মতো ফের তৃণমূলকে পাশে টেনে সরকার গড়ার পথ খোলা রাখার কথা বিজেপি নেতৃত্ব ভেবে রাখছে বলে মত ওই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশ জুড়ে বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনের কথা বললেও, কংগ্রেসকে সে জোটের বাইরে রাখতে চান তিনি। কংগ্রেসকে জোটের বাইরে রেখে আলাদা লড়তে বাধ্য করা হলে আখেরে বিজেপির-ই লাভ হবে এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই পরোক্ষে সেই পথ খুলে দিচ্ছেন বলে এ রাজ্যের বাম ও কংগ্রেস নেতৃত্বের দাবি।
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে কংগ্রেসকেই নিজেদের সবচেয়ে বড় নিশানা বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বিজেপি। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ, দু’জনেই কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ শুরু করেছেন। জরুরি অবস্থার কথা বার বার তুলে ধরে কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ভাবে অস্পৃশ্য করে তোলার কৌশল নিয়েছেন তাঁরা। কংগ্রেসের তথা গাঁধী পরিবারের ভাবমূর্তি তলানিতে পৌঁছে দিয়ে বিজেপি এমন পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়, যাতে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গড়তে বিভিন্ন আঞ্চলিক দল দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে বাংলায় কি তৃণমূলের সর্বাত্মক বিরোধিতায় যাবে বিজেপি? এমন প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল রাজ্য বিজেপির অন্দরেও। অমিত শাহ এ দিন সে সংশয়ে জল ঢেলে দিয়েছেন বলে বিজেপি সূত্রের খবর।
রাজ্য বিজেপির অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র সায়ন্তন বসু বললেন, ‘‘বৈঠকে অমিত শাহ স্পষ্ট জানিয়েছেন, তৃণমূলের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতার প্রশ্ন নেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও সে বার্তা আগেই দিয়েছেন। তিনি সরাসরি বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন। যে সব শব্দ তিনি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে প্রয়োগ করেছেন, কেরলের মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কেও ততটা কঠোর শব্দচয়ন প্রধানমন্ত্রী মোদী করেননি। সেখান থেকেই বুঝে নেওয়া উচিত, তৃণমূলকে এক বিন্দু জমিও ছাড়া হবে না। সর্বভারতীয় সভাপতি এ দিন নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে বৈঠকে সেই বার্তা আরও স্পষ্ট ভাবে দিয়েছেন।’’
বিজেপি সূত্রের খবর, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যের ৪২টি কেন্দ্রেই বিজেপি সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাক, অমিত শাহ এমনই চাইছেন। ৪২টি কেন্দ্রেই যদি সর্বশক্তি প্রয়োগ করা হয়, তা হলেই কাঙ্খিত ২২টি আসন এ রাজ্য থেকে জেতা সম্ভব বলে অমিত শাহ মনে করছেন। ২০১৯-এ বাংলায় অন্তত ২২টি আসন বিজেপি নেবেই এবং ২০২১-এ বাংলায় বিজেপি সরকার গড়বেই, এ বিষয়ে কারও কোনও সংশয় থাকা উচিত নয় এবং সেই লক্ষ্যে যা করা দরকার, তা এখন থেকেই করতে হবে— অমিত শাহের বার্তা মোটের উপর এই।
নির্বাচনী প্রস্তুতির বৈঠক সেরে হাওড়ার শরৎ সদনে দলের সোশ্যাল মিডিয়া টিমের সঙ্গে বৈঠক করেন অমিত। তার পরে ফের কলকাতায় ফেরেন এবং জি ডি বিড়লা সভাঘরে বিদ্বজ্জনদের সভায় যোগ দেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ব্যানারে ওই সভার আয়োজন হয়েছিল। প্রথম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জাতীয় স্মারক বক্তৃতা শীর্ষক অনুষ্ঠানে অমিত শাহের মঞ্চে হাজির ছিলেন বঙ্কিমের জীবনীকার তথা শিক্ষাবিদ অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। ছিলেন নেতাজি গবেষক পূরবী রায়, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অচিন্ত্য বিশ্বাস,বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য স্মৃতিকুমার সরকার এবং আরও বেশ কয়েক জন খ্যাতনামা বাঙালি।
দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা এবং ‘বন্দে মাতরম’ গানটির ভূমিকা অমিত শাহ ব্যাখ্যা করেন নিজের ভাষণে। সে প্রসঙ্গ আসতেই ফের দলের কেন্দ্রীয় নীতিতে ফিরে গিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আক্রমণ শানান বিজেপি সভাপতি। তিনি বলেন, ‘‘বন্দে মাতরমকে রাষ্ট্রগান হিসেবে নেওয়ার প্রস্তাব যখন এল, তখন কংগ্রেস পুরো গানটাকে নিল না। দুটো স্তবক নিল। এই ভুল যদি কংগ্রেস না করত, তা হলে হয়তো দেশটা ভাগাভাগি হয়ে যেত না।’’ তোষণের রাজনীতি করতে গিয়ে কংগ্রেস বন্দে মাতরমকে ‘টুকরো’ করে দিয়েছিল বলে অমিত শাহ মন্তব্য করেন। কংগ্রেসের সেই নীতিই পরবর্তী কালে দেশটাকে ‘টুকরো’ করে দিল বলে তিনি দাবি করেন। তাঁর কথায়— দেশভাগের জন্য কংগ্রেস কখনও খিলাফৎ আন্দোলনকে দায়ী করে, কখনও মুসলিম লিগকে দায়ী করে, কিন্তু আসলে দায়ী কংগ্রেসের তোষণ নীতি।
বিদ্বজ্জনদের সঙ্গে সভা সেরে অমিত শাহ বুধবার ভারতীয় জাদুঘরে আশুতোষ শতবর্ষ হলে চলে যান। সেখানে বৈঠক করেন বিস্তারকদের সঙ্গে। গোটা রাজ্যে ৩৫০ জন বিস্তারক নিয়োগ করা হয়েছে। ব্লকে ব্লকে সংগঠন বাড়ানোর দায়িত্ব রয়েছে তাঁদের উপরে। ২০১৯-এর আগে যে কোনও মূল্যে সংগঠন বাড়াতেই হবে— বিজেপি সভাপতি এই বার্তাই দিয়েছেন বিস্তারকদের। ঠিক এই বার্তা দুপুরের বৈঠকে নির্বাচন ব্যবস্থাপনা কমিটিকে দিয়েছিলেন তিনি। কোনও সংশয় নয়, কোনও অজুহাত নয়, ২০১৯ এবং ২০২১-এর নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি সঙ্ঘাতের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করুক দল— বাংলার সফরের প্রথম দিনে অমিত শাহের বার্তা এমনই।