দু’নৌকোয় পা দিয়ে রাজ্যে উভয়সঙ্কটে বিজেপি

ভোট ময়দানে নেমে পদে পদে তৃণমূল-বিরোধিতা। আবার বিভিন্ন বিল পাশ করার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পেতে পশ্চিমবঙ্গকে একের পর এক সুবিধে পাইয়ে দেওয়া। এ ভাবে দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলতে গিয়েই কি পশ্চিমবঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি? হ্যাঁ, মনে করছেন, জাতীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের একটা বড় অংশ। এমনিতে এ রাজ্যে দলের সংগঠন নেই, দলের মুখও নেই। তার উপর ভোটে সন্ত্রাস, লুঠ তো ছিলই।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৫
Share:

ভোট ময়দানে নেমে পদে পদে তৃণমূল-বিরোধিতা। আবার বিভিন্ন বিল পাশ করার সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পাশে পেতে পশ্চিমবঙ্গকে একের পর এক সুবিধে পাইয়ে দেওয়া। এ ভাবে দু’নৌকোয় পা দিয়ে চলতে গিয়েই কি পশ্চিমবঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়েছে বিজেপি?

Advertisement

হ্যাঁ, মনে করছেন, জাতীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের একটা বড় অংশ। এমনিতে এ রাজ্যে দলের সংগঠন নেই, দলের মুখও নেই। তার উপর ভোটে সন্ত্রাস, লুঠ তো ছিলই। তার পরেও আর একটি বিষয়ের খেসারত এ বারের পুরভোটে দিতে হয়েছে বলে মনে করছেন বিজেপি নেতৃত্ব।

কী ধরনের খেসারত? বিজেপি নেতৃত্বের অনুমান, ভোটারদের মনে ধারণা তৈরি হয়েছে যে, তৃণমূলের সঙ্গে বিজেপির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছে। ফলে জনমানসে তৃণমূলের বিকল্প হয়ে উঠতে পারেনি বিজেপি।

Advertisement

পুরভোটের ফলাফল পর্যালোচনা করে এই মর্মে একটি রিপোর্ট বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ ও সংগঠনের নেতা রামলালের কাছে গতকালই জমা দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহ। দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহও আর একটি রিপোর্ট তৈরি করে অমিত শাহকে দিয়েছেন। বিজেপি সূত্রের মতে, তৃণমূল-ঘনিষ্ঠ ভাবমূর্তি না পাল্টালে বিধানসভায় ভাল ফলের প্রত্যাশা করা যাবে না। মানুষ তৃণমূলকেই ফের বেছে নেবে।

কী ভাবে জনমানসে তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ধারণা তৈরি হয়েছে?

এক, মুকুল রায় এই ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা পালন করেছেন। বিজেপি নেতাদের একাংশের মতে, মুকুল রায় দূরত্ব বজায় রেখেও আদতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে কাজ করে চলেছেন। এক দিকে অরুণ জেটলির মতো শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে দেখা করছেন মুকুল। কিন্তু ভোটের সময় তাঁর ছেলে শুভ্রাংশু তৃণমূলে যথেষ্ট দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। ফলে অনেকেই ভাবতে পারেন, সিবিআই তদন্ত লঘু করতেই মুকুল বিজেপি-নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ চালিয়ে যাচ্ছেন।

দুই, ভোটের আগে বিজেপি কেন্দ্রীয় বাহিনীর দাবি নিয়ে গলা ফাটিয়েছে। শেষ পর্যন্ত যখন রাজ্যের তরফে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাওয়া হয়, তখন কেন্দ্র সেই আবেদনে সাড়া দেয়নি। ফলে ধারণা তৈরি হয়েছে, তৃণমূলকে সুবিধেই করে দিচ্ছে বিজেপি। শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের দ্বারস্থ হওয়ার পরে মুখরক্ষার তাগিদে কেন্দ্রীয় বাহিনী এল বটে। কিন্ত যতটা প্রয়োজন ছিল, তার তুলনায় খুবই কম।

তিন, দলগত ভাবে বিজেপি যতই আক্রমণাত্মক ভূমিকা নিক, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক ভাল রাখার তাগিদে মোদী সরকার নানা বিষয়ে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে সুবিধে পাইয়ে দিয়েছে। সে বাজেটে অতিরিক্ত সাহায্যই হোক বা ভোটের ঠিক মুখে শিক্ষক নিয়োগে ছাড়। ভোটব্যাঙ্কে এর ফায়দা তুলেছেন তৃণমূলনেত্রী। এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ধর্ম মেনে রাজ্যগুলোকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন বিলেও তৃণমূলের সমর্থন দরকার। বিশেষ করে রাজ্যসভায় যেখানে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আজও তৃণমূল নেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন জানিয়েছেন, পণ্য ও পরিষেবা বিলে সম্পূর্ণ সমর্থন করবে তাঁদের দল। মমতাও বার্তা পাঠিয়েছেন, সিলেক্ট কমিটি বা সংসদের স্থায়ী কমিটিতে পাঠিয়ে এই বিলটিতে দেরি করানোর পক্ষপাতী নয় তৃণমূল। এমনকী কংগ্রেস বা অন্য কোনও দল যদি এর বিরোধিতা করে, তা হলেও তৃণমূল হুইপ জারি করে এই বিল পাশ করাতে সরকারকে সমর্থন করবে।

এই পরিস্থিতিতে উভয়সঙ্কটে বিজেপি। দলের কিছু শীর্ষ নেতার মত, পশ্চিমবঙ্গে দলের সংগঠন এখনও মজবুত হয়নি। না হলে কেন্দ্র রাজ্যকে কী কী সুবিধে দিচ্ছে, তার খতিয়ান দিয়ে ভোটে সুবিধে করতে পারত বিজেপি-ও। লোকসভা ভোটের পর এ রাজ্যে বহু মানুষ বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের সাংগঠনিক কাঠামোয় ধরে রাখতে পারেনি দল। কেন? এক রাজ্য নেতার ব্যাখ্যা, ‘‘আমরা যে ভাবে সংগঠন করতে চেয়েছি তা পদ্ধতিগত ভাবে এ রাজ্যে অচল। এখানে উত্তর বা পশ্চিম ভারতের মডেল কাজে দেবে না।’’ ওই নেতার কথায়, ‘‘অমুক শিবির তমুক শিবির করে সংগঠন গড়ে তোলা যায় না। অন্তত, এখানে। এই বাংলায়।’’ এ রাজ্যের রাজনৈতিক চরিত্র হিন্দি-বলয় তো বটেই, দেশের অন্যান্য অংশের চাইতে আলাদা। এ রাজ্যের মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার কথা মাথায় রেখেই এ রাজ্যে সংগঠন গড়ে তোলার পদ্ধতি ঠিক করতে হবে বলে মনে করেন ওই নেতা।

দলের কর্মীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজের এলাকার সাধারণ লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করেন না। অন্য দলের, বিশেষ করে বাম বা তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা যে ভাবে মানুষের আপদে-বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তেমন বিজেপি কর্মীদের করতে দেখা যায় না। ফলে, এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়ে পড়ছেন বহু বিজেপি কর্মীই।

তা হলে পশ্চিমবঙ্গে এখন কী কর্মসূচি নেবে বিজেপি? রাজ্য নেতৃত্বের কর্মসূচির একদম প্রথমেই রয়েছে, ভোট-পরবর্তী সন্ত্রাসে কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন পুর-এলাকায় যে সব কর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের পাশে দাঁড়ানো। ১ মে থেকে এই কাজ পুরোদমে শুরু করে দেবেন রাজ্য নেতৃত্ব। তা ছাড়া, ৬ মে-র পরে জাতীয় স্তরের তিন নেতা পশ্চিমবঙ্গে আসছেন। উদ্দেশ্য, কী ভাবে রাজ্যের ৪৩ লক্ষ সদস্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি করা যায়, তা দেখা। এক নেতার মতে, পুরভোট রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে হয়েছে। বিধানসভা নির্বাচন হবে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে। ফলে তখন এত সন্ত্রাস করতে পারবে না তৃণমূল। যাঁরা তৃণমূলের ভয়ে বা রিগিংয়ের জন্য ভোট দিতে পারেননি, তাঁরা তখন অবাধে ভোট দিতে পারবেন।

তার আগে সংগঠন মজবুত করে তৃণমূলের বিকল্প হয়ে ওঠাই লক্ষ্য বিজেপির।

(সহ প্রতিবেদন: সুকান্ত সরকার)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন