তাদের স্বপ্ন, পশ্চিমবঙ্গের ‘শাপমোচন’ ঘটানো! লোকসভা নির্বাচনের আগে ও পরে বিজেপি-র বিশ্বাস ছিল, নিজেদের জোরেই সে স্বপ্নপূরণ সম্ভব। কিন্তু দু’টি পূর্ণ ও একটি অর্ধেক পুর-নিগমের ভোটের আগে ঘাটতি দেখা গিয়েছে বিজেপি-র সেই প্রত্যয়ে!
বিজেপি-রই অন্দরের ব্যাখ্যা, লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী প্রায় দেড় বছরে দলের সাংগঠনিক শক্তি আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে, অতীতের সাফল্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।
নবকলেবরে বিধাননগর ও আসানসোল পুর-নিগম এবং হাওড়া পুরসভার মধ্যে নতুন অন্তর্ভুক্ত বালির ১৬টি ওয়ার্ডের ভোট আগামী ৩ অক্টোবর। সীমানা পুনর্বিন্যাসের পরে নতুন বিধাননগর পুরসভার সল্টলেক এলাকায় পড়েছে ১৪টি ওয়ার্ড। লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে তার মধ্যে ৯টি আসনে এগিয়ে আছে বিজেপি। নতুন আসানসোল পুরনিগমের মধ্যে আসানসোল এলাকায় ৫৪টি ওয়ার্ড রয়েছে। তার মধ্যে লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ৩২টিতেই বিজেপি এগিয়ে। বস্তুত, বিজেপি-র এই এগিয়ে থাকার কারণেই পুর-নিগম গঠনের কারণ দেখিয়ে আসানসোল ও বিধাননগরের ভোট রাজ্য সরকার পিছিয়ে দিয়েছে বলে মনে করে সব বিরোধী দলই।
কিন্তু লোকসভা ভোটের সময়কার এই পরিসংখ্যান এখন আর খুব কার্যকর মনে হচ্ছে না! লোকসভা ভোটে এ রাজ্যে প্রায় ১৭% ভোট পাওয়ার পরে বিজেপি নেতৃত্বের গলায় ছিল তৃণমূলকে উৎখাতের হুঙ্কার। লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে বিধাননগর, আসানসোল এবং বালিতে তাদের যা অবস্থান, তাতে এই পুর-যুদ্ধেও সেই হুঙ্কার আরও এক পর্দা চড়ারই কথা ছিল। কিন্তু বাস্তব হল, গেরুয়া শিবিরের অনেক নেতা-কর্মীই এখন জনান্তিকে মেনে নিচ্ছেন, লোকসভা এবং পুরভোট এক নয়। লোকসভা ভোটে মোদী ঝড় ছিল। এখন তা থেমেছে। ওই ঝোড়ো হাওয়া ধরে রাখতে যে সংগঠন দরকার, এক বছরের বেশি সময় পেয়েও তা গোছানো যায়নি। ফলে, ভোটের কয়েক দিন আগে থেকে ভোটের দিন পর্যন্ত এলাকায় শাসক দল যে ‘সন্ত্রাস’ চালাবে বলে বিরোধীদের আশঙ্কা, তা মোকাবিলার সংগঠন বিজেপি-র হাতে মজুত নেই।
এর সঙ্গেই রয়েছে বিজেপি-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও। সংগঠন-সহ কয়েকটি প্রশ্নে বিজেপি-র ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের সঙ্গে অন্য অংশের বিরোধ সম্প্রতি তীব্র হয়েছে। ফলে, যেটুকু শক্তি আছে, সেটুকুও তৃণমূল-বিরোধী লড়াইয়ে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না বিজেপি। লড়াইয়ের নিয়ম মেনে দলের নেতারা অবশ্য প্রকাশ্যে ইতিবাচক তত্ত্ব আওড়াচ্ছেন। যেমন— বিধাননগরের ভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গ একটা অভিশপ্ত সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতোই বিধাননগরের মানুষও শাপমোচনের অপেক্ষায় আছেন। নাগরিকেরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলে তৃণমূল জিতবে না!’’ এই শহরে বিজেপি-র কৌশল— বিপুল ঢক্কানিনাদ না করে সাদামাঠা ভাবে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া এবং ভোটের দিন মানুষ যাতে অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, তার জন্য রাস্তায় থাকা।
আসানসোলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয় প্রচারে বলছেন, বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী পরিষেবা দেবে। বাবুলের কথায়, ‘‘আসানসোলের মতো আগাছা-জঞ্জাল ভর্তি শহর ভারতে আর আছে কি না, সন্দেহ! লোকসভা ভোটের সময় এই শহরের মানুষ তীব্র জলসঙ্কটের কথা বলেছিলেন। আমি ভোটে জিতে সাংসদ তহবিল থেকে টাকা দেওয়া সত্ত্বেও সে সমস্যা মেটেনি। সাংসদ টাকা দিলেও উন্নয়ন হবে কি না, তা পুরসভার উপরে নির্ভর করে।’’ এই কারণেই বাবুলেরা চান, সাংসদ হিসাবে দায়িত্ব সম্পূর্ণ করার জন্য পুরসভাটাও তাঁদের হাতে আসুক।
আসানসোলের দায়িত্বে থাকা আর এক বিজেপি নেতা সুভাষ সরকারের দাবি, ‘‘এই শহরের মানুষ তৃণমূলের উপরে বিরক্ত। এটা বিজেপি-শাসিত ঝাড়খণ্ডের লাগোয়া। সব মিলিয়ে আসানসোলে আমরা খুবই ভাল অবস্থায় আছি।’’ কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল হলেও ভোট অবাধ হবে কি না, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সন্দিহান।
অবাধ ভোট হওয়া নিয়ে আশঙ্কায় বালির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায়ও। কিন্তু দলের অন্দরেই এখন প্রশ্ন উঠছে, এই পরিস্থিতিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সংগঠনকে কেন তৈরি করা গেল না?
দলের একাংশের ব্যাখ্যা, আসলে গত এক বছরে রাজনৈতিক লড়াইয়ের তুলনায় গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বেই বেশি সময় গিয়েছে! তার উপরে কেন্দ্রীয় নেতারা বাংলার মাটি না বুঝে মহাসম্পর্ক অভিযান, প্রশিক্ষণ শিবিরের মতো কিছু কর্মসূচি চাপিয়ে দিয়েছেন। আর রাজ্য সরকারের প্রতি কেন্দ্রের সহযোগিতার বার্তা থেকে তৃণমূল-বিজেপি নৈকট্যের জল্পনাই জোরদার হয়েছে। পরিসংখ্যানে ভাল জায়গায় থেকেও তাই পুরভোটের তিন শহরে স্বস্তিতে নেই গেরুয়া বাহিনী!