পরের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলকে হারিয়ে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় আসছে বলে দাবি করলেন দলের জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ।
আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লোকসভা নির্বাচনে দলের ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ বলেন, “৩৪ বছরের সিপিএমের অপশাসনে তিতিবিরক্ত বাংলা তৃণমূলের পক্ষে রায় দিয়েছিল। কিন্তু কিন্তু তিন বছর যেতে না যেতেই রাজ্যের মানুষ বুঝেছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ। আর কংগ্রেস তো গোটা দেশেই পরিত্যক্ত। পশ্চিমবঙ্গে তারা প্রান্তিক দলে পরিণত। সেখানে বিজেপি-ই আজ প্রধান বিকল্প।”
প্রধান বিরোধী থেকে শাসক হয়ে ওঠার লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই দলের রাজ্য শাখাকে সর্বাত্মক ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন বিজেপি সভাপতি। রাজ্যে সন্ত্রাসের ঘটনায় একাধিক বার কেন্দ্রীয় দল পাঠিয়ে শাসক তৃণমূলকে চাপেও রেখেছে বিজেপি। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের আগে আগামী বছরের পুরভোট তাদের সামনে বড় পরীক্ষা। এই অবস্থায় চৌরঙ্গি ও বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের মুখে সেপ্টেম্বরের গোড়ায় রাজ্যে যাচ্ছেন অমিত শাহ। গোড়ায় ঠিক ছিল শিলিগুড়িতে দলীয় সভা করবেন তিনি। কিন্তু উপনির্বাচনের আগে কর্মীদের চাঙ্গা করতে সভার জায়গা পাল্টে কলকাতা করা হয়েছে। তৃণমূলের পায়ের তলার জমি কাড়তে বিজেপি যে মরিয়া, সেটা স্পষ্ট।
সাধারণ ভাবে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ। গত লোকসভা ভোটে যা বেড়ে ১৬ শতাংশ হয়। অথচ রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে গেলে এই হার ৪০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। মাত্র দু’বছরে সেটা কি সম্ভব? নাকি, ২০১৬-র পরের ভোটের জন্য কৌশল নির্ধারণ করছে বিজেপি?
অমিত অবশ্য বলছেন, “এ বারে হবে না, পরের বার জিতব এ ভাবে কোনও রণকৌশল হয় না। এ বারই জিতব, এই দৃঢ়তা নিয়েই আমাদের ঝাঁপাতে হবে। বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন মমতার মধ্যে ওই দৃঢ়তা ছিল। বিজেপিরও সেই আত্মপ্রত্যয় রয়েছে। সেই জন্যই আমরা পারব।”
কিন্তু নরেন্দ্র মোদী সরকারের সঙ্গে তৃণমূলের তলে তলে সমঝোতার সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনাও তো কম নয়। গোড়ায় প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি নিয়োগের অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করেও পরে তৃণমূল তা সমর্থন করায় সেই জল্পনা আরও জোরদার হয়েছে। মোদী সরকারও গোড়া থেকেই মমতার সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলে আসছে। প্রধানমন্ত্রী মোদী নিজেই এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি মমতার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী। আগ্রহী রাজ্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেও। রাজ্যের আর্থিক দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি।
অমিত শাহ অবশ্য এই গোটা বিষয়কেই কেন্দ্র-রাজ্যের স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবেই দেখছেন। তাঁর কথায়, “প্রধানমন্ত্রী একশো বার দেখা করুন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। দু’জনের দেখা হওয়াটা দুই সরকারের মধ্যে সাংবিধানিক সম্পর্কের বিষয়।” কিন্তু সেই সম্পর্কের বাইরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তৃণমূলের জন্য এক ইঞ্চি জমিও যে বিজেপি ছাড়বে না, সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। অমিত বলেন, “তৃণমূল এনডিএ-র শরিক নয়। অদূর ভবিষ্যতে তারা এনডিএ-তে যোগ দেবে, এমন কোনও সম্ভাবনার কথাও মমতা জানাননি। সুতরাং দলের সভাপতি হিসাবে আমার কাজ হল বিজেপি যাতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে, সেটা দেখা। আপনিই বলুন না, মমতা বিজেপি সভাপতি হলে তিনিও কি একই কাজ করতেন না?”
এই পরিস্থিতিতে সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে কোণঠাসা তৃণমূলকে দম ফেলার সুযোগ যে কেন্দ্র দেবে না, তা-ও স্পষ্টই জানিয়ে দিচ্ছেন অমিত। তিনি বলেন, “ভোট প্রচারের সময়ে খোদ নরেন্দ্র মোদী পশ্চিমবঙ্গে গিয়ে বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে সারদা কেলেঙ্কারির শেষ দেখে ছাড়বেন। পশ্চিমবঙ্গের ভোট পর্ব মেটার আগেই সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়। তখন মোদী সেই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি কি আপস করবেন? কখনওই না। তিনি দুর্নীতির প্রশ্নে কোনও রাঘব বোয়ালকেই রেয়াত করছেন না। সুতরাং সারদার ব্যাপারেই বা সিবিআই তদন্তে তিনি নাক গলাতে যাবেন কেন!”
দুর্নীতির প্রশ্নে মমতার সরকারের উপর কেন্দ্রের চাপ, আর রাজ্যে দলীয় সংগঠনের লাগাতার আন্দোলন এই জোড়া কৌশলেই পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চাইছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। দলীয় সূত্র বলছে, দলীয় সংগঠন প্রসারের কাজে রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের উপরেই ষোল আনা আস্থা রাখছেন তাঁরা। অমিত নিজেও বলেন, “রাহুল এক জন স্ট্রিট ফাইটার। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। মমতা সরকারের ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে এখন জেলায় জেলায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বাংলায় লাল-সবুজের বদলে এ বার গৈরিক পতাকা তোলার দায়িত্ব মানুষের। কারণ, বিজেপি মানে উন্নয়ন। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকায় পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নে আরও সুবিধা হবে।”
কিন্তু ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোটের রাজ্যে বিজেপির প্রভাব বিস্তার করাটা কি কঠিন কাজ নয়? তা ছাড়া, ধর্মনিরপেক্ষ বলে এ রাজ্যের মানুষের একটা পরিচিতি আছে। তাদের হিন্দুত্বের দাওয়াটাই বা গেলানো হবে কী ভাবে?
অমিত বলেন, “হিন্দুত্ব বিজেপির প্রচারের বিষয় নয়। বহুত্ববাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পটভূমিতে ওটা দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গে আমাদের প্রচারের অগ্রাধিকার একটিই বিষয় তা হল রাজ্যের অনুন্নয়ন, জেলায় জেলায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস।”
বিজেপি সূত্র বলছে, পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশের মতো বিষয়কে প্রচারের হাতিয়ার করার পরিকল্পনা রয়েছে অমিত শাহের। সংখ্যালঘু ভোটের একটা বড় অংশ যে তারা পাবে না, এটা বিলক্ষণ জানে বিজেপি। তাই তাদের পাখির চোখ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোট। এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে মোদী হাওয়া থাকলেও, ২০১৬ পর্যন্ত সেটা ধরে রাখা দুষ্কর, বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব সেটা বিলক্ষণ জানেন। আর সেই কারণেই মমতার সরকারের উপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও প্রশাসনিক দুর্বলতাগুলিকেই প্রচারের হাতিয়ার করার কৌশল নিচ্ছেন অমিত শাহ।