হিমঘরে বিস্ফোরণ! অতঃপর...

আনাজ-শস্য জমা রাখতে হিমঘর প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার গ্যাসপাইপ ফেটে অ্যামোনিয়া ছড়িয়ে পড়লে বদলে যায় মাটি-জল-বায়ু। খালে ভাসে মৃত মাছ। জল হয়ে যায় কালো। গাছের রং বদলে যায়। এখন তেমনই ঘটছে জলপাইগুড়ি শহর এলাকায়। লিখছেন অনির্বাণ রায়বাতাসে অ্যামোনিয়ার গন্ধ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে নাকে রুমাল চাপা দিতে বাধ্য হতে হবে। মাথা ভার হয়ে আসবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:৫১
Share:

হিমঘর ঠান্ডা রাখতে ব্যবহৃত হয় অ্যামোনিয়া গ্যাস

বাতাসে অ্যামোনিয়ার গন্ধ স্পষ্ট। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে নাকে রুমাল চাপা দিতে বাধ্য হতে হবে। মাথা ভার হয়ে আসবে। জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে সরু খাল বয়ে গিয়ে পড়েছে নদীতে। গ্রামের লোকের বলে নালা। প্রচুর নদীয়ালি মাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়ে খালে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছিপ ফেলে বসে থাকতে দেখা যেত অনেককে। সেই খালে এখন ছিপ ফেলছেন না কেউ। কার্যত খালের ধারেকাছে যাচ্ছেন না। কারণ, রাশি রাশি মরা মাছ ভেসে আছে খালে। স্বচ্ছ জলের খাল এখন নিকষ কালো।

Advertisement

ভাদ্রের হাওয়ায় সদ্য বার হওয়া ধানের গাছে শিশির দুলত। কচি সবুজ রঙের সেই গাছের রং এখন হলুদ। বাঁশগাছের মাথা ঝলসে গিয়েছে। কেষ্টমাঝির গাভি লক্ষ্মী ক’দিন ধরে কালো গোবর দিচ্ছে। যে রাতে হিমঘরে বিস্ফোরণ হয়েছিল, গ্রামের সকলে ঘর ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। তবে, থেকে গিয়েছিল লক্ষ্মী। ভোররাতে পাইপ-ফাটা গ্যাস মিশে গিয়েছিল বাতাসে। সেই বাতাস থেকেই লক্ষ্মী নিশ্বাস নিতে বাধ্য হয়েছিল গোটা রাত, পরের ভোর-সকাল-দিন-রাত।

জলপাইগুড়ি শহর ছুঁয়ে রয়েছে পেল্লায় হিমঘর। এই এলাকার অন্যতম পুরনো হিমঘর। সরকারি খাতায় জায়গাটির নাম হলদিবাড়ি মোড়। ওই মোড় থেকে একটি রাস্তা জলপাইগুড়ি শহর ছুঁয়ে চলে গিয়েছে হলদিবাড়ি। সেই কারণেই মোড়ের নামকরণ। আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জোড়দিঘি, নয়াবস্তি, চূর্ণকর বস্তি, বানিয়াপাড়ার মতো ছোট ছোট জনপদ। ঘিঞ্জি বসতি। দূষণে আক্রান্ত পুরো এলাকা। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ভোরে হিমঘরের পাইপ ফেটে যায়। আগুন লাগে হিমঘরে। সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও গ্যাস নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। হিমঘর শীতল রাখতে অ্যামোনিয়া গ্যাস ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সেই গ্যাস যে অতি মারাত্মক, এতদিনে তা জেনে গিয়েছেন কোনওদিন স্কুলে পা রাখেননি, এলাকার এমন বাসিন্দারাও। কেষ্টমাঝিই যেমন বললেন, “অতি সাংঘাতিক গ্যাস! ফ্রিজেও গ্যাস থাকে। সে অন্য গ্যাস। সেই গ্যাস গায়ে লাগলে শীতল বোধ হয়। এই অ্যামোনিয়া গ্যাস লাগলে হাত-পা পুড়ে যায়!’’ তিনি এই গ্যাসের বিবরণ শুনেছেন হিমঘরের গ্যাস চেম্বার মেরামত করতে আসা কর্মীদের থেকে।

Advertisement

কলকাতা থেকে গ্যাল চেম্বার মেরামত করার কর্মীরা এসেছিলেন। হিমঘরের গেট-লাগোয়া দোকানে বসে তাঁরা চা খেয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে তাঁদের।

চায়ের দোকান চালান উৎপলা দাস। তাঁর বিবরণ, “হিমঘরের পাশ দিয়ে যাওয়া খালটার জল প্রতিদিন একটু একটু করে কালো হয়ে যাচ্ছে! কুয়ো থেকে জল তুলে চা বানাতাম। এখন সেই জল ফুটলেই কালো রং হয়ে যাচ্ছে! দোকান থেকে জলের বোতল কিনে চা বানাতে হচ্ছে!’’

এলাকায় পানীয় জলের উৎস বলতে কুয়ো। কুয়োর জলের স্বাদ বদলে গিয়েছে বলে এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন। সেই জল খেয়ে তিনদিন খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র প্রিয়াংশুর। তিন দিনে অন্তত আটবার বমি করেছে ছেলেটি, শক্ত কিছু মুখে দিতে পারেনি। প্রিয়াংশুর বাবা প্রশান্তবাবু বলেন, “এখন তবু ছেলেটা কিছু খেতে পারছে। তবু সারাদিন ওর মাথা ব্যথা করে, আগের মতো হাসিখুশিও নেই আর ও!’

হিমঘরের গ্যাসের পাইপ ফাটার পরে দু’সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। তবু হিমঘরের সামনে দাঁড়ালে অ্যামোনিয়া গ্যাসের গন্ধ স্পষ্ট টের পাওয়া যায়। হিমঘরের গেটের কাছেই পানের দোকান চালান মাধবী চূর্ণকার। তিনি বলছেন, “পেট তো চালাতে হবেই! তাই কিছু করার নেই আমার! দোকান নিয়ে বসতেই হচ্ছে এখানে! তবে, বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া করতে পারি না! কেমন যেন অরুচি ধরে গিয়েছে!”

বাসিন্দাদের বক্তব্য— হিমঘরের গ্যাস-পাইপ ফাটার কারণে খালে রাশিরাশি মাছের মৃত্যু, গবাদি পশুর অসুস্থ হয়ে পড়া, ধানগাছ-বাঁশগাছ পুড়ে যাওয়ার খবর প্রশাসন জানে; দিনকয়েক আগে সেখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিবিরও বসেছিল; কিন্তু মাটি বা গাছের স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও পর্যন্ত করা হয়নি। এই গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে থাকলে কী কী ক্ষতি হবে, তার থেকে মুক্তি মিলবে কী ভাবে, তাও প্রশাসন বিশদে জানাচ্ছে না বলেও এলাকার লোকজনের অভিযোগ।

এলাকার বাসিন্দাদের এখন প্রধান চিন্তা পানীয় জল নিয়ে। হিমঘর থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে বাড়ি সুজিত রায়ের। তিনি বলেন, “জলের স্বাদ আর আগের মতো নেই। পানসে লাগে, কখনও তিতকুটে মনে হয়। দোকান থেকে বোতলের জল কিনে বাড়ির বাচ্চাগুলোকে খাওয়াচ্ছি। কতদিন এমন চলবে জানি না!”

চারপাশে বিস্তৃত ধানের খেত। সেই খেতে এবার কেমন ফসল হবে, তা নিয়েও চিন্তায় সকলে। গ্যাসের জেরে ধানগাছ সবুজ থেকে লাল রঙের হয়ে গিয়েছে। শম্ভু রায়ের দেড় বিঘা জমির ধানের রং বদলে গিয়েছে।। তিনি বলেন, “গাছগুলো যেন ঝলসে গিয়েছে! এখনও মরেনি অবশ্য। তবে, গাছ বেঁচে থাকলেও ধান কি আর ফলবে! ধান হলেও তা কি খাওয়া যাবে! কিছুই বুঝতে পারছি না! গরু-বাছুরগুলোও পাতলা গোবর দিচ্ছে!”

সকাল হলে পাখির ডাকে জাতীয় সড়ক মুখর হয়ে যেত। সকালের দিকে যান চলাচল বেশি হয় না। সে সময় দোয়েল-ফিঙের ডাক ভেসে বেড়াত এক গাছ থেকে আর এক গাছে। হিমঘর-কাণ্ডের পরে সকালের দিকে পাখির সেই চেনা ডাকও শুনতে পাচ্ছেন না বাসিন্দারা। হিমঘরের সামনে চায়ের দোকানে বসে থাকা জটলা একমত— বাতাস থেকে গ্যাস পুরোপুরি না কাটলে পাখির দলও ফিরবে না। কবে আগের মতো সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে, তারই অপেক্ষায় রয়েছেন বানিয়াপাড়া, জো়ড়াদিঘি, নয়াবসতি, হলদিবাড়ি মোড়ের বাসিন্দারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন