‘আমি গর্ভপাত করাতাম ঠিকই, কিন্তু শিশু বিক্রির বিজনেসে নামিয়েছে স্বামী’

মাটির হাত কয়েক নীচেই শুয়ে ছিল ওরা। কেউ সময়ের আগে জন্ম হওয়ায় কখনও পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখেইনি।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

হাবরা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩০
Share:

সিআইডি-র সঙ্গে আর এক অভিযুক্ত (মাঝে) পলি দত্ত ওরফে উৎপলা। —ফাইল চিত্র।

মাটির হাত কয়েক নীচেই শুয়ে ছিল ওরা। কেউ সময়ের আগে জন্ম হওয়ায় কখনও পৃথিবীর আলো-বাতাস দেখেইনি। কেউ সেই স্বাদ পেয়েছিল, তবে মাত্র দিন কয়েকের জন্য। তারপরে বিস্কুটের পেটিতে, থার্মোকলের উপরে শুয়ে কলকাতা থেকে দূরের পথ পাড়ি দেওয়ার ধকল সইতে না পেরে চিরতরে চোখ বোজে।

Advertisement

জমির তলা থেকে যখন ওই শিশুদের দেহাবশেষ তুলে আনা হচ্ছে, তখনও নির্বিকার মুখে পাশে দাঁড়িয়ে পলি দত্ত, সত্যজিৎ সিংহরা। শিশু পাচার চক্রের অন্যতম কুশীলব হিসাবে যারা আপাতত সিআইডি হেফাজতে।

শুক্রবার সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার হাবরা থানার মছলন্দপুরের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জমি থেকেই মিলেছে দু’টি শিশুর দেহাবশেষ। একজনের দেহের হাড়গোড় কার্যত গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। অন্যজনের দেহাবশেষের সঙ্গে ইংরেজি হরফে ‘মেক্সিকো’ লেখা একটি ছেঁড়াখোঁড়া গেঞ্জি মিলেছে। তদন্তে যা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে বলে জানাচ্ছেন এক সিআইডি কর্তা। দু’টি দেহ উদ্ধারের পরে নিয়মমাফিক পাঠানো হয় বারাসত জেলা হাসপাতালে। সেখানে এমন দেহাবশেষের ময়না-তদন্তের মতো পরিকাঠামো না থাকায় পরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

Advertisement

প্রাথমিক তদন্তে সিআইডি কর্তাদের অনুমান, একটি শিশু সম্ভবত সময়ের আগে জন্মানোয় পৃথিবীর আলোই দেখেনি। অন্যটি যখন মারা যায়, বয়স তিন-চার দিন হবে। দু’টি দেহই বছরখানেকের মধ্যে পোঁতা হয়েছিল বলেও মনে করছেন তাঁরা।

কিন্তু সময়ের আগে জন্মানো শিশুকে বাঁচানো সম্ভব নয় জেনেও কেন প্রসব করানো হয়েছিল?

পলির কাছ থেকে সিআইডি জানতে পেরেছে, তার হাতে শাঁসালো খদ্দের ছিল। শিশুর বরাত আসে। পলির কাছে স্থানীয় এক মহিলার খোঁজ ছিল, যিনি সে সময়ে সাত মাসের গর্ভবতী ছিলেন। তাঁকেই বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ‘চান্স’ নিয়েছিল পলিরা। কিন্তু শেষমেশ মৃত শিশু প্রসব হয়। যাকে কবর দেওয়া হয় ট্রাস্টের জমিতেই।

এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ট্রাস্ট এবং সংলগ্ন জমিতে ১২টি জায়গায় কোদাল-বেলচা দিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলে। সিআইডি কর্তারা ছাড়াও ছিল হাবরা থানার পুলিশ, র‌্যাফ। হাজির ছিলেন হাবরা ১ বিডিও শুভ্র নন্দী।

বৃহস্পতিবার বিকেলেই পলি, সত্যজিৎদের এনে জমির কিছু কিছু অংশ খোঁড়ার জন্য চিহ্নিত করেছিলেন সিআইডি কর্তারা। রাতেই সেই কাজ এগোবে বলে মনে করা হয়েছিল। হ্যালোজেন লাগানো হয় মাঠে। বেলচা-কোদাল হাতে আসেন কয়েকজন শ্রমিক। কিন্তু রাতে ফিরে যান সিআইডি কর্তারা।

সকালে পলি-সত্যজিৎকে দু’টি আলাদা গাড়িতে করে আনা হয় ট্রাস্টে। এ দিন সঙ্গে ছিল মাসুদা বিবি নামে ধৃত আরও একজন। ওই মহিলাকে দিয়েই মৃত শিশু বা ভ্রূণ মাটিতে পুঁতে ফেলত পলিরা, জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তিনজনকে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে এ দিন ফের জমি চিহ্নিত করা হয়। পরে সকলকে হাজির করানো হয় এক সঙ্গেও। ট্রাস্টের পিছনে মাঠ থেকে একটি শিশুর দেহাবশেষ মেলে। অন্যটি মেলে পাশের জমি থেকে।

সিআইডি-র একটি সূত্র জানাচ্ছে, প্রায় পাঁচ মাস আগেই বিদেশের একটি ফোনের সূত্রে তাঁরা জানতে পেরেছিলেন, মছলন্দপুরের এই ট্রাস্ট বা বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম (যেটি ইতিমধ্যেই সিল করেছে সিআইডি) থেকে শিশু পাচারের ব্যবসা চলছে। সেই মতো তদন্তের জাল পাতা হয়। দু’টি জায়গাতেই ছদ্মবেশে হাজির হন গোয়েন্দারা। কিন্তু সম্ভবত কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হওয়ায় সে সময়ে কোনও শিশুকে হাজির করানো হয়নি। বলে দেওয়া হয়, এখানে কোনও বাচ্চা পাওয়া যাবে না। কিন্তু হাল ছাড়েননি গোয়েন্দারা।

তদন্ত এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে সিআইডি কর্তারা জানতে পেরেছেন, মছলন্দপুরের এই ট্রাস্টের ঘরে বহু মহিলার বেআইনি গর্ভপাত করানো হতো। সেটা ছিল রোজগারের একটা পথ। এ ছাড়া, ভবঘুরে বা মানসিক ভারসাম্যহীন মহিলাদের রাস্তায় দেখতে পেলে তাদের ধরে আনা হতো ট্রাস্টে। সেখানে খাইয়ে-পরিয়ে কিছু দিন রেখে প্রসব করানো হতো। পরে ওই মহিলাদের ফের ছেড়ে আসা হতো রাস্তাতেই। ওই শিশুদেরও চড়া দামে বিক্রি করে দিত পলিরা। রোজগারের আরও এক ধরনের সুলুক-সন্ধান পলি নিজেই দিয়েছে গোয়েন্দাদের। জানিয়েছে, প্রত্যন্ত গ্রামের গরিব পরিবারের মহিলারা গর্ভবতী হলে তাদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে জন্মের পরে কয়েক হাজার টাকার বিনিময়ে সদ্যোজাতকে কিনে নেওয়া হতো।

পলি এ দিন বলে, ‘‘আমি গর্ভপাত করাতাম ঠিকই। কিন্তু শিশু বিক্রির বিজনেসে আমাকে নামিয়েছে স্বামী (দ্বিতীয়) অতিক্রম ব্যাপারী। শুরু শুরুতে আমি এই কাজের কিছু বুঝতাম না। ও-ই পথ দেখিয়েছে।’’

পথ যে-ই দেখুক, কান টেনে সেই মাথার কাছে পৌঁছনোরই চেষ্টা করছেন গোয়েন্দারা।

ইতিমধ্যে আরও জানা গিয়েছে, কলকাতার যে সব নার্সিংহোমের সঙ্গে (বেহালার সাউথভিউ বা মহাত্মা গাঁধী রোডের শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের কথা ইতিমধ্যেই জানা গিয়েছে) শিশু বিক্রির ব্যবসার ‘টাই-আপ’ ছিল পলিদের, সেখান থেকেও সদ্যোজাতদের আনা হতো মছলন্দপুরের ট্রাস্টে। কিন্তু সেই আনার সেই পদ্ধতি শুনে থ’ দু’দে গোয়েন্দারাও। কী জানতে পেরেছেন তাঁরা? বিস্কুটের পিচবোর্ডের পেটির ভিতরে রাখা হতো থার্মোকলের টুকরো। তার মধ্যে কাপড়-চোপড়ে মুড়িয়ে রাখা হতো শিশুদের। উপরে পিচবোর্ড চাপা দিয়ে গাড়িতে তুলে পাঠান হতো ট্রাস্টের হেফাজতে। ওই ট্রাস্টের ঘর থেকে বেশ কিছু পেটি, থার্মোকল উদ্ধার হয়েছে।

রাজারহাট-নিউটাউন রোডের ধারে একটি ধাবায় হাতবদল হতো শিশুর। কলকাতা থেকে এত দূরের পথ আসার ধকল সহ্য করতে না পেরে কোনও শিশু মারা গেলে ওই ধাবার পাশের জমিতে ফেলে দেওয়া হতো। মছলন্দপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে দিতে দুধের শিশুরা যদি হিক্কা তুলে মরেই যেত, তবে তাদের পুঁতে ফেলা হতো ট্রাস্টের জমিতে। তেমনই একটি শিশুর দেহ এ দিন মিলেছে বলে গোয়েন্দাদের অনুমান। শুক্রবার বিকেলের দিকে ধৃত তিনজনকে নিয়ে ফিরে গিয়েছেন তাঁরা। তবে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ আরও চলবে বলে জানাচ্ছে সিআইডি-র একটি সূত্র।

এ দিন ট্রাস্টের ঘর থেকে পাওয়া বিস্কুটের পেটিতে রেখেই ময়না-তদন্তের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় দু’টি শিশুর দেহাবশেষ। গালা দিয়ে এঁটে দেওয়া হয় বাক্সের মাথা।

আরও একবার বন্ধ বাক্সে রওনা দিল ওরা। তবে শ্বাস বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা নেই, এটুকুই যা তফাত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন