বাবা-মাকে মিলিয়ে দিয়ে সংসার জোড়া লাগাল ছেলে

বাবা-মায়ের ঝগড়া হয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল সংসার। মনের দুঃখে দাদুর বাড়ি থেকে পালিয়েছিল ছেলেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই জেদে জোড়া লাগল ঘর। সন্তানের মুখ চেয়ে আবার এক হলেন বাবা-মা।

Advertisement

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল ও প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:৫৯
Share:

বাবা-মায়ের সঙ্গে আফতাব। ছবি: সুজিত মাহাতো।

বাবা-মায়ের ঝগড়া হয়েছিল। ভেঙে গিয়েছিল সংসার। মনের দুঃখে দাদুর বাড়ি থেকে পালিয়েছিল ছেলেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারই জেদে জোড়া লাগল ঘর। সন্তানের মুখ চেয়ে আবার এক হলেন বাবা-মা।

Advertisement

সুখী পরিবারের ফ্রেম চিড় সারিয়ে আবার হাসিমুখে।

কাহিনির শুরু চোদ্দো বছর আগে। ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুরুলিয়ার জয়পুরের বাসিন্দা সানাউল্লা আনসারির সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের জাহিদা খাতুনের। সাংসারিক খিটিমিটির জেরে বিয়ে ভাঙল চার বছরের মাথায়। কিন্তু তত দিনে কোলে এসে গিয়েছে আফতাব। ছোট্ট শিশুর চোখের সামনেই আলাদা হয়ে গেলেন বাবা-মা।

Advertisement

মায়ের সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের ধানবাদ জেলার বারকি-তে চলে গিয়েছিল আফতাব। দাদুর বাড়িতে শুরু হয়েছিল তার নতুন জীবন। কেটে গিয়েছিল বেশ কয়েকটা বছরও। কিন্তু আফতাবের মনের দুঃখ সারেনি। এখন তার বয়স তেরো। ফেব্রুয়ারি মাসে এক দিন বাড়িতে বকুনি খেয়ে প্রবল অভিমানে ঘর ছাড়ল সে। আদ্রা স্টেশনে তাকে একা একা ঘুরে বেড়াতে দেখে যখন উদ্ধার করল রেল পুলিশ, মুখে কুলুপ এঁটেছিল আফতাব। তার ঠাঁই হল আদ্রার অরুণোদয় শিশু নিকেতন হোমে। সেখানেই স্কুলে পড়াশোনা শুরু করল সে। হোমের সম্পাদক নবকুমার দাস জানান, মার্চের মাঝামাঝি আফতাব এক দিন তাঁদের কাছে বাড়ির সব কথা খুলে বলে। ঠিকানা পেয়ে তাঁরা খবর দেন আফতাবের দাদু আতাবউদ্দিনকে। আসেন মা জাহিদাও। কিন্তু অভিমানে মায়ের সঙ্গে প্রথমে কথা বলেনি আফতাব। চায়নি ফিরে যেতে। তখন আতাবউদ্দিনের থেকে সানাউল্লার ঠিকানা নিয়ে ডেকে পাঠানো হয় তাঁকেও। বাবা এবং মা আলাদা-আলাদা ভাবে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেন।

জেলায় শিশুকল্যাণ কমিটি এই মুহূর্তে কার্যকরী না থাকায় আবেদনপত্র পৌঁছয় জেলাশাসকের কাছে। কিন্তু এ বার বেঁকে বসে খোদ আফতাবই। গোঁ ধরে, বাবা-মা যদি একসঙ্গে থাকেন, তবেই বাড়ি ফিরবে। হোম কর্তৃপক্ষ জাহিদা এবং সানাউল্লাকে একসঙ্গে বসিয়ে তাঁদের কাছে কথাটা পাড়েন। প্রথমে চমকে উঠেছিলেন দু’জনেই। পুরনো দিনের কথা তুলে এক প্রস্ত ঝগড়াও হয় দু’জনের মধ্যে। তার পরে একটু একটু করে বরফ গলে।

৬ জুন আদ্রারই গোপীনাথপুরের একটি মসজিদে ফের বিয়ে করেন সানাউল্লা-জাহিদা। গোপীনাথপুর বড় মসজিদের ইমাম গিয়াসউদ্দিন আনসারি জানান, শরিয়তি আইন অনুযায়ী, বিচ্ছেদের পরে আগের স্ত্রী-র সঙ্গে পুনর্বিবাহে ছেলেদের জন্য কোনও নিষেধ নেই। তবে বিবাহ-বিচ্ছিন্না স্ত্রীকে ফের অন্য কারও সঙ্গে বিবাহ করে নিদেন পক্ষে এক রাত একসঙ্গে থাকতে হবে। সেই বিবাহে বিচ্ছেদ নিয়ে অপেক্ষা করতে হবে নিদেন পক্ষে তিন মাস তেরো দিন। তার পরে ফের প্রথম স্বামীর সঙ্গে নতুন করে বিয়ে হতে পারবে। তিনি জানান, জাহিদার মাঝে একটি বিয়ে হওয়ায় (২০০৮-এ হওয়া সে বিয়েও ভেঙেছে) পুনর্বিবাহে আর কোনও বাধা ছিল না।

নিকাহ-র পরে রঘুনাথপুর কোর্টে গিয়ে বিবাহের ঘোষণাপত্র তৈরি করেন জাহিদারা। দু’জনে একসঙ্গে সেই নথি নিয়ে আবেদন করেন ছেলেকে ফিরে পেতে। মাস তিনেক তাঁদের মিলেমিশে সংসার করার প্রমাণ মেলার পরে জেলাশাসক তন্ময় চক্রবর্তী আফতাবকে বাবা-মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশপত্রে সই করেন। জেলাশাসক বলেন, ‘‘ওঁরা দু’জনে একসঙ্গে ছেলেকে ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। ছেলেটিও তা-ই চেয়েছিল।’’ দম্পতির দাবি, আফতাবই তাঁদের ভাবতে বাধ্য করেছে কোনটা বড়— সন্তানের হাসিমুখ না নিজেদের দূরত্ব? মনের টান যে দিকে গিয়েছে, তাঁরা সানন্দে এগিয়েছেন সে দিকে। সত্যি করে দিয়েছেন জনপ্রিয় সিনেমার সংলাপ, ‘স্বামী-স্ত্রীর বিচ্ছেদ হতে পারে, বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয় না’।

কিন্তু ছেলের মুখ চেয়ে বাঁধা জুটি মজবুত হবে তো? রিলেশনশিপ কাউন্সেলর পারমিতা মুখোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সন্তানেরা চায় বাবা-মা এক সঙ্গে থাকুন। তবুও তো বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এ ক্ষেত্রে যেটা হল— তা বাচ্চাটার ভবিষ্যতের পক্ষে খুব ভাল। ওই দম্পতির পক্ষে কতটা ভাল হল, সেটা সময় বলবে।’’

সানাউল্লা দম্পতি কিন্তু আশাবাদী। জয়পুরের জামরা গ্রামের বাড়িতে বসে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সানাউল্লা নিজে বলেন, ‘‘মাঝের দশটা বছর ছেলে কাছে থাকত না। কিন্তু প্রায়ই স্কুলে গিয়ে আড়াল থেকে ওকে চোখের দেখা দেখতাম।’’ জাহিদাও বলেন,
‘‘বাবার কাছে থাকতে না পারায় আফতাবের কষ্ট হচ্ছে বুঝতাম। তাই ও যখন এমন শর্ত দিয়ে বসল, আর
কিছু ভাবিনি।’’

আর কিছু ভাবছে না আফতাবও। এখন থেকে একটি কেন্দ্রীয় প্রকল্প থেকে পড়াশোনার জন্য প্রতি মাসে এক হাজার টাকা করে পাবে সে। এ বার বাবা-মা বকলে কী হবে? মুচকি হেসে কিশোর বলল, ‘‘যা-ই করি, বাড়ি ছেড়ে পালাব না!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন