সিদ্ধান্ত জেলা সিপিএমের

মহল্লায় চলবে ঘুষের ভিডিও

দল ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে তৃণমূল করে আসছেন। বাম আমলে বহুবার গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। দলের হয়ে প্রাণ দিতে দেখেছেন পড়শির জোয়ান ছেলেটাকেও। মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া একতলা বাড়িটা আজও পাকা করে উঠতে পারেননি।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০১৬ ০১:৪৫
Share:

প্রতিবাদে মুখর। মঙ্গলবার সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডের কাছে তোলা নিজস্ব চিত্র।

দৃশ্য ১: দল ক্ষমতায় আসার বহু আগে থেকেই নিষ্ঠার সঙ্গে তৃণমূল করে আসছেন। বাম আমলে বহুবার গ্রামছাড়া হতে হয়েছে। দলের হয়ে প্রাণ দিতে দেখেছেন পড়শির জোয়ান ছেলেটাকেও। মাটির দেওয়াল আর খড়ের ছাউনি দেওয়া একতলা বাড়িটা আজও পাকা করে উঠতে পারেননি। নানুরের ওই বৃদ্ধ তৃণমূল কর্মীকে প্রবল ধাক্কা দিয়েছে ২৪ ঘণ্টা আগে টিভির পর্দায় দেখা ছবিগুলো। দলের প্রতি এখনও বিশ্বাস না টললেও বৃদ্ধকে বিচলতি করেছে শীর্ষ নেতাদের ‘ঘুষ’ নেওয়ার ওই ছবি। তদন্তে অভিযোগ সত্যি প্রমাণিত হলে কী করবেন, ঠিক করে উঠতে পারছেন না তিনি।

Advertisement

দৃশ্য ২: তিনি জেলার একটি পরিচিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘বিহারে দীর্ঘ দিন থেকেছি। কোথাও কোনও কাজ করাতে প্রায়ই শুনতে হয়েছে, স্বামীজী ‘কুছ তো খিলাইয়ে’। মনে মনে গর্ব হতো বাংলার জন্য। কই সেখানে তো এমন হয় না। এ বার বাংলার বাইরে আর মুখ দেখানোর উপায় রইল না!’’

সোমবার দিল্লির ‘নারদ’ নিউজের স্টিং অপারেশনে ঘুষ-কাণ্ডে জড়িয়ে গিয়েছে শাসকদল তৃণমূলের তাবড় নেতানেত্রীর নাম। ওই সব ভিডিও-র সত্যতা এখনও যাচাই না হলেও নারদ সংস্থার দাবি, ২০১৪ সাল থেকে গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত দু’বছর ধরে ওই অপারেশ চালানো হয়েছে। নতুন সংবাদসংস্থা রূপে আত্মপ্রকাশ করার সেরা সময় হিসাবে বিধানসভা ভোটের পূর্ব মুহূর্তকেই তারা বেছে নিয়েছে। দলীয় নেতাদের লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার ওই ভিডিওকে যতই বিরোধীদের কুৎসা-ষড়যন্ত্র বলে চালানোর চেষ্টা হোক না কেন, দৃশ্যতই চরম অস্বস্তিতে শাসকদল। এই মুহূর্তে কী বলবেন আর কী বলবেন না— তা-ই ঠিক করে উঠতে পারছেন না জেলার তৃণমূল নেতারা।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে পড়েছে বিরোধী দলগুলিও। বস্তুত, এই স্টিং অপারেশন প্রবল আলোড়ন ফেলেছে জনমানসেও। নিন্দা-সমালোচনা এবং পাল্টা অস্বীকারে ঝড় উঠেছে ফেসবুক থেকে পাড়র চায়ের ঠেকেও। প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে কেউ বলছেন, ‘‘এত দিন লোকে দলের বিরুদ্ধে বলত। বিশ্বাস হতো না। এ বার বিষয়টা সত্যিই চাক্ষুস করলাম!’’ শাসকদলের অন্ধভক্ত এমন অনেকেরও প্রতিক্রিয়া, ‘‘খুব কষ্ট পেয়েছি!’’ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ তো বটেই, গৃহবধূ থেকে কলেজপড়ুয়া, সরকারি কর্মী থেকে ব্যবসায়ী— সর্বস্তরের মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে এই ঘুষ বিতর্ক। প্রভাব থেকে মুক্ত নন নানুরের ওই বৃদ্ধ এবং সন্ন্যাসীও।

ভোটের মুখে এমন ঘটনা কতটা বেকায়দায় ফেলল তৃণমূলকে? এই নারদ-কাণ্ডকে সামনে রেখে নিজেদের অনুকূলে কি ভোট টানতে সক্ষম হবে বিরোধী দলেরা? মূলত এ নিয়েই আলোচনা চলছে সর্বত্র। জেলার রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শহরাঞ্চলে মানুষের মধ্যে ওই ঘুষ-কাণ্ডের প্রভাব ভাল মতোই পড়তে পারে। তবে, গ্রামের দিকে মানুষ এ ব্যাপারে কতটা সচেতন হবে, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। দুই এলাকাতেই অনেকেই আবার ভিডিও ফুটেজের সত্যতা নিয়েই দোলাচলে রয়েছেন। আবার বিরোধীরা কতটা পরিকল্পিত ভাবে এবং দীর্ঘস্থায়ী ভাবে সাধারণ মানুষের কাছে ওই বিতর্ক নিয়ে যেতে পারেন, তার উপরে অনেকটাই নির্ভর করছে নারদ-কাণ্ডের হুলের বিষ কতটা প্রভাব ফেলবে এ বারের ভোটে।

বিরোধীরা যদিও এখন থেকেই তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তুলে সরব হতে শুরু করেছে। সারদার পরে এই নারদ কাণ্ডই তৃণমূলকে হারানোর প্রধান হাতিয়ার হতে চলেছে বলে দাবি করছে বাম-কংগ্রেস জোটের নেতারা। ‘‘গলি গলি মে শোর হ্যায়/ তৃণমূল পক্কা চোর হ্যায়— এটাই তো স্লোগান,’’— বলছেন সিপিএমের জেলা সম্পাদক মনসা হাঁসদা। মঙ্গলবারই বৈঠকে বসেছিল সিপিএমের জেলা কমিটি। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছে, এই ঘুষ-কাণ্ডকে সামনে রেখে বুথে বুথে মিছিল করা হবে। সকলকে জানানোর জন্য তৃণমূলের নেতাদের ঘুষ নেওয়ার ছবির পোস্টার এবং সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের কাটিংও পৌঁছে দেওয়া হবে গ্রামে গ্রামে, বাড়িতে বাড়িতে। শুধু তা-ই নয়, পাড়ায় পাড়ায় মহল্লায় মহল্লায় প্রকাশিত ভিডিও ফুটেজ দেখানোর ব্যবস্থাও করবে সিপিএম। মনসা হাঁসদা বলছেন, ‘‘যা-ই করা হোক তা যাতে নির্বাচনী বিধিভঙ্গের সামিল না হয়, সেটা খেয়াল রাখা হবে।’’ দলের জেলা সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মিও জানিয়েছেন, ঘুষ বিতর্ককে সামনে রেখেই প্রচার চালাবে কংগ্রেসও। তার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে এ দিনই সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডে তদন্ত করে দোষীদের গ্রেফতারির দাবিতে যৌথ বিক্ষোভ-মিছিল করেছে বাম-কংগ্রেস। পিছিয়ে নেই বিজেপিও। ‘মমতা সরকারের পদত্যাগে’র দাবি জানিয়ে মিছিল করেছে নলহাটি ও রামপুরহাটে।

এ দিকে, অস্বস্তি নিয়েই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ নেমে পড়েছেন জেলার তৃণমূল নেতারাও। এ দিন সকাল থেকেই বোলপুরের গীতাঞ্জলি প্রেক্ষাগৃহে দলের জেলা কমিটিকে নিয়ে একটি রূদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেছিলেন ঘুষ-কাণ্ডে নাম জড়ানো তথা দলের জেলা পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিম। জেলার ১১টি বিধানসভা কেন্দ্র ও বর্ধমানের দু’টি মিলিয়ে (আউশগ্রাম ও মঙ্গলকোট) মিলিয়ে তৃণমূলের ১৩ জন প্রার্থীও হাজির ছিলেন সেখানে। বৈঠক শুরু হওয়ার পরে সংবাদমাধ্যমকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। সকাল ১১টায় শুরু হওয়া ওই বৈঠক চলে দুপুর ২টো পর্যন্ত। তৃণমূল সূত্রের খবর, বিধানসভা ভোটে কী ভাবে এগোতে হবে তার রণকৌশল ঠিক করা, কোথায় দলের অবস্থান দুর্বল, কোন কেন্দ্রে বিরোধী প্রার্থী বেগ দিতে পারে, তার মোকাবিলা করার পন্থা কী হবে— এ রকম নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বৈঠকে। এরই পাশাপাশি নারদের স্টিং অপারেশনকে ‘কুৎসা-অপপ্রচার’ ও বিরোধীদের ‘চক্রান্ত’ আখ্যা বলেই নেতা-কর্মীদের প্রচার করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে।

নেতারা এই পরামর্শ দিলেও ভোটের মুখেই এমন ধাক্কায় মুষড়ে পড়েছেন দলের নেতা-কর্মীদের (বিশেষত শহরাঞ্চলের) অনেকেই। এ দিনও সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ফিরহাদের জবাব ছিল, ‘‘এটা কুৎসা করা হচ্ছে। এটা অপপ্রচার। আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোনও অনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত নই।’’

(সহ প্রতিবেদন: মহেন্দ্র জেনা)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement