মাত্র ১ টাকা দাওয়াইয়ে খুশি নন বাস মালিকরা

জেদ ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বাসভাড়া বাড়াতে রাজি হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও গত দু’বছরে জ্বালানি-সহ পরিবহণের বিভিন্ন খরচ যে হারে বেড়েছে, তার তুলনায় সামান্যই। সরকারি-বেসরকারি সব বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি ধাপে বাড়ছে এক টাকা করে। দীর্ঘ টালবাহানার পরে সরকারের এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নন বাস মালিকরা। শনিবার সরকারের সিদ্ধান্ত জানার পরই তাঁরা বলেছেন, “ভেন্টিলেশনে ছিলাম। বেডে এলাম। কিন্তু এতে সুস্থ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৪ ০৩:০৯
Share:

সাংবাদিক বৈঠকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার নবান্নে। নিজস্ব চিত্র

জেদ ছেড়ে শেষ পর্যন্ত বাসভাড়া বাড়াতে রাজি হলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও গত দু’বছরে জ্বালানি-সহ পরিবহণের বিভিন্ন খরচ যে হারে বেড়েছে, তার তুলনায় সামান্যই। সরকারি-বেসরকারি সব বাস ও মিনিবাসের ভাড়া প্রতি ধাপে বাড়ছে এক টাকা করে।

Advertisement

দীর্ঘ টালবাহানার পরে সরকারের এই সিদ্ধান্তে মোটেই খুশি নন বাস মালিকরা। শনিবার সরকারের সিদ্ধান্ত জানার পরই তাঁরা বলেছেন, “ভেন্টিলেশনে ছিলাম। বেডে এলাম। কিন্তু এতে সুস্থ হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই।” তবে ভবিষ্যতে জ্বালানির দামের ওঠাপড়ার অনুপাতে ভাড়া বাড়ানো-কমানোর একটা ব্যবস্থা চালু হওয়ার আশা জাগিয়ে এ ব্যাপারে একটি টাস্ক ফোর্স গড়ার কথা ঘোষণা করেছে সরকার। যদিও তাতেও সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি থেকেই যাবে। সব চেয়ে বড় কথা, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা থাকবে মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই।

কবে থেকে চালু হবে নয়া ভাড়া ও টাস্ক ফোর্স?

Advertisement

বাস মালিকদের সংগঠনগুলির সঙ্গে শনিবার মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পর শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে পাশে রেখে পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, নতুন ভাড়ার ব্যাপারে খুব শীঘ্রই সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি হবে। সেখানেই বলা থাকবে, কবে থেকে তা চালু হচ্ছে। আর ডিজেলের দামের সঙ্গে সমানুপাতে বাসভাড়া নির্ধারণের টাস্ক ফোর্স কাজ শুরু করবে আগামী ১ বৈশাখ থেকে। অর্থাৎ প্রায় সাত মাসের অপেক্ষা।

ভাড়াবৃদ্ধি ও টাস্ক ফোর্স, দু’টি নিয়েই বেশ কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, বাস মালিকদের যা ভাবাচ্ছে। ভাড়ার ব্যাপারে যেমন তাঁরা স্পষ্টই বলেছেন, বাস পরিষেবাকে পুরোপুরি সুস্থ করে তুলতে বাস ও মিনিবাসে ন্যূনতম ভাড়া হওয়া দরকার যথাক্রমে ৮ টাকা ও ১০ টাকা। কিন্তু তার বদলে বাড়ানোর পরেও ন্যূনতম ভাড়া হবে যথাক্রমে ৬ টাকা ও ৭ টাকা। বাস মালিকরা তো বটেই, সরকারি কর্তাদের একাংশও মনে করছেন, এতে পরিবহণ শিল্পের সমস্যা মিটবে না। কারণ, আয়ের অভাবে ধুঁকছে সরকারি বাস পরিষেবাও।

প্রশ্ন টাস্ক ফোর্সের কার্যকারিতা নিয়েও। অন্য কয়েকটি রাজ্যে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যে ফল বা সাফল্য পাওয়া গিয়েছে, সে কথা মাথায় রেখেই এই টাস্ক ফোর্সের কথা ভাবা হয়েছে। এ কথা জানিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ও পরিবহণ সচিব জানান, আগামী ১ বৈশাখ (১৪ এপ্রিল) থেকে জ্বালানির দাম বাড়া-কমার পরিমাণ দু’টাকায় পৌঁছলেই সেই অনুপাতে বাসভাড়া নির্ধারণ করবে টাস্ক ফোর্স। সরকার ও বাস মালিক প্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া হবে এই টাস্ক ফোর্স।”

বাস মালিকরা তাতে খুশি নন। তাঁদের এক নেতার বক্তব্য, “আমরা দীর্ঘদিন ধরেই ভাড়া নির্ধারণের একটি স্বাধীন সংস্থা তৈরির দাবি জানিয়ে আসছি। বিদ্যুৎ বা টেলিকম ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে। ওই সব সংস্থায় কোনও সরকারি প্রতিনিধি থাকেন না। কিন্তু পরিবহণের টাস্ক ফোর্সে সরকারি কর্তারা থাকবেন। অথচ কোনও বিশেষজ্ঞকে রাখা হয়নি।” সরকারের এক কর্তার অবশ্য মত, “টাস্ক ফোর্সে সরকারি প্রতিনিধি না থাকলে প্রতি ক্ষেত্রেই ভাড়া বাড়ানোর দাবি উঠতে পারে। সরকারের পক্ষে তা মানা সম্ভব নয়। তাই ওই কমিটিতে সরকারি কর্তাদের রাখা হয়েছে।”

হবেই যদি, তবে সাত মাস পরে কেন চালু হবে টাস্ক ফোর্স?

সরকারি কর্তাদের একাংশ মনে করছেন, ডিজেলের দাম বিনিয়ন্ত্রণে নরেন্দ্র মোদী সরকারের পরিকল্পনার কথা মাথায় রেখেই এটা করা হয়েছে। পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্যে বিগত ইউপিএ সরকার মাসে ৫০ পয়সা করে ডিজেলের দাম বাড়িয়ে চলার নীতি নিয়েছিল। পার্থবাবুই এ দিন স্বীকার করেছেন গত দু’বছরে ২৩ বার (২৫% শতাংশেরও বেশি) দাম বেড়েছে ডিজেলের। মোদী সরকার মনে করছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দর ও ডলারের দাম দুই-ই মোটামুটি আয়ত্তে রয়েছে। এ ভাবে চললে, চলতি বছরেই ভর্তুকি তুলে দিয়ে ডিজেলের দাম পুরোপুরি বিনিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ফলে আগামী আর্থিক বছর থেকে ডিজেলের দাম পুরোপুরি সরকারি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে আসবে। তাই আগামী আর্থিক বছর থেকেই তেলের দামের সঙ্গে ভাড়াকে যুক্ত করার ব্যবস্থা চালু করলে বাস মালিকরাও যেমন আশ্বস্ত বোধ করবেন, তেমনই তেলের দামের সঙ্গে ভাড়া বাড়লেই রাজ্য সরকারকে ততটা চাপে পড়তে হবে না।

তবে টাস্ক ফোর্স মনে করলেই যে বাসভাড়া বাড়বে, সে নিশ্চয়তা দেননি পার্থবাবু। নবান্নের খবর, তখনও ভাড়ার ব্যাপারে শেষ বোতামটি থাকবে মুখ্যমন্ত্রীরই হাতে। আর এটাই চিন্তার বিষয় বাস মালিকদের। রাজ্যবাসীর উপরে আর্থিক বোঝা চাপাবেন না বলেই দু’বছর বাসভাড়া বাড়াতে দেননি মুখ্যমন্ত্রী। রেলমন্ত্রী থাকার সময়েও এই যুক্তিতেই তিনি রেল ও মেট্রোরেলের ভাড়া বাড়াতে দেননি। পার্থবাবুর কথায়, “সরকারের দায়বদ্ধতার কারণে এবং জনগণের দুর্গতি যাতে না-বাড়ে, সে দিকে খেয়াল রাখতেই ভাড়াবৃদ্ধি করা যায়নি।”

পরিবহণ দফতরের কিছু কর্তা কিন্তু মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রী এমন গোঁ ধরে থাকায় যাত্রীদেরই ক্ষতি। এক কর্তার কথায়, “দু’বছরে অর্ধেকেরও বেশি বেসরকারি বাস ও অনেক সরকারি বাস বসে যাওয়ায় বেশি ভাড়া দিয়ে অটো-ট্যক্সিতে যেতে হচ্ছে মানুষকে। ক্ষতিটা পরোক্ষে তাঁদেরই।”

সঙ্কট থেকে পরিবহণ শিল্পের মুক্তির দাবি জানিয়ে বাস মালিকরা বারবার ধর্মঘট ডেকেও শাসক দলের চাপে পিছিয়ে গিয়েছেন। অনড়ই থেকেছেন মুখ্যমন্ত্রী। পরিবহণ-কর্তারা জানাচ্ছেন, সম্প্রতি সরকারকে না জানিয়ে শহরের রাস্তা থেকে ট্যাক্সির উধাও হয়ে যাওয়া, সেই পথে বাস সংগঠনেরও যাওয়ার প্রস্তুতির কথা জেনেই অশনি সঙ্কেত দেখেন শাসক দলের নেতারা। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে আসরে নামেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। বাস মালিকদের সঙ্গে তিনি দফায় দফায় আলোচনায় বসেন। তৃণমূল সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীকে সার্বিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে ভাড়া বাড়াতে রাজি করানোর ক্ষেত্রে মুকুলবাবুর বড় ভূমিকা রয়েছে। বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সি, পরিবহণের সব ফ্রন্ট একসঙ্গে বিরুদ্ধে গেলে সরকার যে সঙ্কটে পড়বে, তা বোঝানো হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। এর পরেই সবুজ সঙ্কেত দেন মুখ্যমন্ত্রী।

বাস মালিকদের উপরে পুলিশি জুলুম বন্ধ করার দাবিও মেনে নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাস মালিকেরা জানিয়েছেন, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রসচিব এবং পরিবহণ সচিবকে খতিয়ে দেখার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তবে বাসভাড়া বাড়ার সঙ্গে যাত্রী-স্বাচ্ছন্দ্যের বিষয়টিও মালিকদের খেয়ালে রাখতে হবে বলে জানান পার্থবাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন