তাপস-মামলা

খুন-ধর্ষণের হুমকিটা কি অপরাধ নয়, প্রশ্ন কোর্টের

সাংসদেরা তো দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি। তাঁদেরই কেউ খুন করে দেব, ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণ করাব বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে থাকলে সেটা অপরাধ কি না, বুধবার রাজ্য সরকারের কাছে তা জানতে চাইল কলকাতা হাইকোর্ট।

Advertisement

শমীক ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০১৪ ০৪:১৭
Share:

সাংসদেরা তো দায়িত্বশীল জনপ্রতিনিধি। তাঁদেরই কেউ খুন করে দেব, ছেলে ঢুকিয়ে ধর্ষণ করাব বলে প্রকাশ্যে মন্তব্য করে থাকলে সেটা অপরাধ কি না, বুধবার রাজ্য সরকারের কাছে তা জানতে চাইল কলকাতা হাইকোর্ট। সেটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, সে-ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, তা-ও জানতে চান বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত।

Advertisement

গত ১৪ জুন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল নদিয়ার নাকাশিপাড়া ও তেহট্ট থানা এলাকার একাধিক সভায় উস্কানিমূলক বক্তৃতা দিয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ এখনও ওই সাংসদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে কৃষ্ণনগরের এক আইনজীবী পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলে হাইকোর্টের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন। বিচারপতি শুনানির জন্য এ দিন সেই মামলা গ্রহণ করেন। শুনানির শুরুতেই জিপি (গভর্নমেন্ট প্লিডার) অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তিনি জানতে চান, “ওই সাংসদের উক্তি হিসেবে আবেদনকারী যা উল্লেখ করেছেন, প্রকাশ্যে তেমন মন্তব্য করা হলে সেটা কি অপরাধ নয়? আপনি কী মনে করেন?”

সরাসরি জবাব না-দিয়ে জিপি উল্টে বিচারপতি দত্তের কাছেই জানতে চান, তিনি মামলাটি আদৌ শুনতে পারেন কি না? জিপি বলেন, “এ মামলা এই আদালতের বিচারাধীন হতে পারে না। এটি জনস্বার্থের মামলা। ওই উক্তি নিয়ে কেউ অভিযোগও করেননি। তা ছাড়া আইনজীবী বিজন ঘোষ এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা করেছেন বলে শুনেছি। তাই এই আদালতের মামলাটি গ্রহণ করার দরকার নেই।”

Advertisement

আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রত মুখোপাধ্যায় তখন বিচারপতিকে বলেন, “আমার মক্কেল নিজে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেননি ঠিকই। তবে সাংসদের ওই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশি ব্যবস্থার দাবিতে অনেকেই বিভিন্ন থানায় অভিযোগ করেছেন।” ওই সাংসদের মন্তব্য সংক্রান্ত একটি সিডি তিনি আদালতে জমা দিয়েছেন বলে জানান সুব্রতবাবু। তাঁর বিশ্বাস, তাতেই সব স্পষ্ট হবে।

তার পরেই সুব্রতবাবু জিপি-র উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, “কেউ রেড রোডের মাঝখান দিয়ে হেঁটে গেলে তাঁকে না-থামিয়ে পুলিশ কি কারও অভিযোগের অপেক্ষায় থাকবে?”

বিচারপতি: (জিপি-র উদ্দেশে) আবেদনকারী সাংসদের মন্তব্য হিসেবে যা লিখেছেন, তা নিয়ে সরকারের বক্তব্য কী বলুন। সাংসদ ওই কথা বলেছেন কি বলেননি?

জিপি: আবেদনকারী এক বারও বলেননি যে, (সাংসদের ওই মন্তব্যের কারণে) তিনি জখম হয়েছেন। মেডিক্যাল রিপোর্টও নেই!

বিচারপতি: আবেদনকারী কোথাও জানাননি যে, সাংসদের ওই মন্তব্যের জেরে তিনি শারীরিক আঘাত পেয়েছেন কিংবা কেউ তাঁকে আঘাত করেছে। তিনি সাংসদের মন্তব্য খবরের কাগজে পড়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে, এক জন দায়িত্বশীল সাংসদ এই ধরনের উক্তি করতে পারেন না। আবেদনকারী মনে করেন, ওই উক্তির পরে সাংসদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল পুলিশের।

কেন তিনি মামলাটি শুনতে চান, তার ব্যাখ্যা দিয়ে বিচারপতির মন্তব্য, আবেদনকারী শুধু সমাজের কথাই ভাবেননি। সাংসদের ওই মন্তব্যকে তিনি নিজের জীবনের প্রতি হুমকি বলেও ভাবছেন। সেই জন্যই মামলাটি রিট পিটিশন হিসেবে গ্রহণ করা যায়।

বিচারপতি: (জিপি-কে) কেউ আদালতে রিট পিটিশন করলে ধরে নিতে হবে, তিনি সত্য বলছেন। সে-ক্ষেত্রে সরকার তাদের বক্তব্য জানাবে। আপনি সরকারের বক্তব্য জানান। এই ঘটনা সত্য না মিথ্যা, তা জানান।

জিপি জবাব দেননি।

বিচারপতি: আপনারও তো কিছু কর্তব্য আছে। আপনি কি প্রকাশ্যে কাউকে খুন করার কথা বলবেন?

জিপি নিরুত্তর।

বিচারপতি: “মাননীয় জিপি, এই ব্যাপারে সরকারের বক্তব্য কী, সেটা আপনি বলুন। আপনি যা বলবেন, আমি সেটাই নথিভুক্ত করব।

জিপি তবু নিরুত্তর।

বিচারপতি: কেন আমি এই মামলা শুনব, তা আগেই বলেছি। আগের বারের মতো ভুল হতে দেব না আমি। এর আগে আমি আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম। আপনি চাইছেন, এই মামলা সিঙ্গল বেঞ্চে না-হয়ে ডিভিশন বেঞ্চে চলে যাক।

(আইনজীবীরা বলছেন, ‘আগের বার’ বলতে বিচারপতি দত্ত বীরভূমের পাড়ুই গ্রামের খুনের মামলাকেই বুঝিয়েছেন। ওই মামলায় রাজ্য পুলিশের ডিজি-কে নিজের এজলাসে তলব করেছিলেন বিচারপতি দত্ত। জিপি আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় ডিজি হাজির হবেন। কিন্তু ডিজি ওই তারিখে বিচারপতি দত্তের এজলাসে হাজির হননি। উল্টে বিচারপতির নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে চলে গিয়েছিলেন জিপি। ডিভিশন বেঞ্চ ডিজি-র হাজিরার উপরে স্থগিতাদেশ দিয়েছিল। সেই ঘটনার জেরে বিচারপতি দত্ত পাড়ুই মামলা পরে ছেড়ে দেন।)

বিচারপতি দত্ত এ দিন জিপি-কে বলেন, “সরকারের বক্তব্য জেনে এসে আপনি আইনি তর্ক করুন। এখন আপনাকে বলতে হবে না। প্রয়োজনে আপনি সময় চেয়ে নিন।”

জিপি: বৃহস্পতিবারেই খবরের কাগজে বেরোবে, জিপি কিছু বলেননি। আপনি সংবাদমাধ্যমকে বলুন, বিচার প্রক্রিয়ার কথা এ ভাবে প্রকাশ করা যাবে না। অনেক সময়েই তথ্য বিকৃত করে খবর হচ্ছে।

বিচারপতি: আদালত কী ভাবে সংবাদমাধ্যমকে নিষেধ করবে? সুপ্রিম কোর্টও তো নিষেধ করেনি। তবে কোনও খবর বিকৃত হয়ে থাকলে আমাকে জানান। আমি ব্যবস্থা নেব।

এ দিন সকালেই এই মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আবেদনকারীর আইনজীবী সুব্রতবাবু তখন হাজির ছিলেন না। জিপি হাজির ছিলেন। বিচারপতি তখনই জিপি-কে জানান, মঙ্গলবার রাতে টিভি চ্যানেলে সংসদের একটি খবর দেখে তিনি মর্মাহত এবং উদ্বিগ্ন। এক সাংসদ দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এবং অন্য এক সাংসদ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্কে যে-ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে তিনি ব্যথিত।

বিচারপতি: কোনও বিশেষ রাজনৈতিক দলের কথা বলছি না। দেশে আইনের শাসন থাকবে না? রাষ্ট্রের কি কিছুই করার নেই? দেশে বিচার ব্যবস্থা নেই? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? বিচার ব্যবস্থা তা হলে কী করবে? (জিপি-র দিকে তাকিয়ে) টিভি চ্যানেলে সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদারের সাক্ষাৎকার দেখেছেন? লজ্জা বোধ করবেন!

জিপি: আমি আদৌ ওই কাজ সমর্থন করি না। শের শাহের আমলে বা ইরানে অমন ঘটনা হলে হাতের কব্জি কেটে নিত।

বিচারপতি: শের শাহের আমলের কথা ছাড়ুন। দেশে সংবিধান রয়েছে। কব্জি কাটাকে দেশের সংবিধান সমর্থন করে না।

তখনই ঠিক হয় বেলা ২টোয় তাপস পালের মন্তব্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটির শুনানি হবে। ওই মামলায় সরকারকে তাদের বক্তব্য জানাতে হবে ১৭ জুলাই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন