কলকাতা হাই কোর্ট। — ফাইল চিত্র।
এক দিনের ঝগড়া, থাপ্পড় বা লাথি মারার ঘটনাকে নিষ্ঠুরতা (ক্রুয়েলটি) বলে বিবেচনা করা যাবে না! বধূ নির্যাতনের এক মামলায় এমনটাই জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। আদালত জানিয়েছে, এক দিনের ঘটনার ভিত্তিতে বধূ নির্যাতন বা গার্হস্থ্য হিংসার মামলা করা যায় না। এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক বা গুরুতর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন প্রমাণ হওয়া প্রয়োজন। হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, এফআইআর এবং চার্জশিট মিলিয়ে কোনও অপরাধের প্রমাণ মেলেনি। প্রতিহিংসার কারণে স্বামীকে হয়রানির মধ্যে ফেলতে স্ত্রী আইনের অপব্যবহার করেছেন বলে পর্যবেক্ষণ আদালতের। সেই কারণে মহিলার দায়ের করা এফআইআর খারিজের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি অজয়কুমার মুখোপাধ্যায়।
বধূ নির্যাতন বা গার্হস্থ্য হিংসার মামলার ক্ষেত্রে ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দের ব্যাখ্যাও দিয়েছে আদালত। হাই কোর্ট জানিয়েছে, এই ধরনের মামলার ক্ষেত্রে ‘নিষ্ঠুরতা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সাবেক ভারতীয় দণ্ডবিধি (আইপিসি)-র ৪৯০ (এ) ধারায় নিষ্ঠুরতার দু’রকম অর্থ রয়েছে। প্রথমত, ইচ্ছাকৃত কিছু আচরণ যা স্ত্রীকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করে, তা ‘নিষ্ঠুরতা’ বলে বিবেচনা করা যায়। স্ত্রীর জীবন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, মানসিক বা শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপদের কারণ হতে পারে, এমন কোনও কাজও ‘নিষ্ঠুরতা’ বলে বিবেচনা করা যায়। পাশাপাশি, স্ত্রী বা তাঁর পরিবারকে নির্দিষ্ট কিছু চাহিদা (যৌতুক, টাকা, সন্তান) পূরণের জন্য চাপ দেওয়াও ‘নিষ্ঠুরতা’র মধ্যে পড়ে।
এই ঘটনার ক্ষেত্রে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতন এবং স্ত্রী ধন আত্মসাৎ করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন এক মহিলা। তাঁর দাবি, বিয়ের পর থেকে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাঁর উপর মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন করতেন। ২০২২ সালের ৭ জুলাই স্বামী তাঁকে বর্ধমান শহরে মারধর করেন বলেও অভিযোগ। এ ছাড়া তাঁর সকল স্ত্রী ধন আটকে রাখা হয়েছে বলেও দাবি স্ত্রীর। অন্য দিকে, স্বামীর বক্তব্য, দীর্ঘদিন ধরে এক ব্যক্তির সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে রয়েছেন স্ত্রী। সেই ব্যক্তির সঙ্গেই বর্ধমান শহরে দেখা গিয়েছে স্ত্রীকে।
মহিলার স্বামীর আরও দাবি, ২০১৯ সালেই স্ত্রী নিজের টাকা এবং গয়না নিয়ে প্রেমিকের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। এ বিষয়ে তিনি আগেই পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে স্ত্রীও মামলা করেছিলেন। কিন্তু সেখানে বধূ নির্যাতনের কোনও অভিযোগ ছিল না। ২০২২ সালে ফের অভিযোগ দায়ের করেন মহিলা, সেখানে বধূ নির্যাতনের মামলা যোগ করা হয়। স্বামীর আইনজীবীর দাবি, বধূ নির্যাতন বা স্ত্রী ধন আত্মসাতের ক্ষেত্রে ঘটনার তিন বছরের মধ্যে মামলা দায়ের করার নিয়ম। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যে অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। এ অবস্থায় তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে বধূ নির্যাতনের মামলা খারিজের জন্য আদালতে আবেদন জানান আইনজীবী।
আদালত জানিয়েছে, স্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন তিনি নিজের টাকা এবং অন্য জিনিসপত্র নিয়ে স্বেচ্ছায় বাড়ি ছেড়েছেন। তাই স্ত্রী ধন আত্মসাৎ করার অভিযোগ গৃহীত হয়নি। এ ছাড়া ২০২১ সালের মামলায় বধূ নির্যাতনের কোনও অভিযোগ ছিল না। ২০২২ সালে সেই অভিযোগ দায়ের হলে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয় বলেই মনে করছে আদালত। পাশাপাশি ২০২২ সালের জুলাই মাসের ঘটনার প্রেক্ষিতেও আদালত জানিয়েছে, এক দিনের ওই ঘটনাকে স্ত্রীর উপর ‘নিষ্ঠুরতা’ বলে বিবেচনা করা যায় না। এ ছাড়া শ্বশুরবাড়ির বাকিদের বিরুদ্ধেও কোনও অভিযোগ নেই। মহিলা ২০১৯ সালে শ্বশুরবাড়ি ছেড়েছিলেন। কিন্তু বধূ নির্যাতনের মামলা করেছেন ২০২২ সালে। এ ক্ষেত্রে তিন বছরের সময়সীমার মধ্যে মামলা দায়ের করা হয়নি। আদালত জানিয়েছে, এটিকে নিষ্ঠুরতা বলে বিবেচনা করা যাবে না। কারণ, এতে ধারাবাহিক কোনও মানসিক বা শারীরিক নির্যাতনের প্রমাণ মেলেনি। পাশাপাশি, যৌতুক বা অবৈধ কোনও দাবিতে চাপ দেওয়া হয়েছে বলেও প্রমাণ মেলেনি।
মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের কথাও উল্লেখ করেছে হাই কোর্টের বিচারপতি মুখোপাধ্যায়ের বেঞ্চ। শীর্ষ আদালতের রায়ের কথা উল্লেখ করে হাই কোর্ট জানিয়েছে, স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে বধূ নির্যাতনের আইনকে প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে আদালতের সতর্ক থাকা উচিত। হাই কোর্ট জানিয়েছে, এফআইআর এবং চার্জশিট মিলিয়ে কোনও অপরাধের প্রমাণ মেলেনি। প্রতিহিংসার জেরেই স্বামীকে হয়রানির মধ্যে ফেলতে স্ত্রী আইনের অপব্যবহার করেছেন বলে মনে করছে আদালত। তাই ওই এফআইআর খারিজের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারপতি।