পুলিশের যান নিয়ন্ত্রণের প্রশংসা করেছে কলকাতা হাই কোর্ট। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
মিছিলের ভিড় থাকুক বা জনসভার, কলকাতা পুলিশ দেখাল, তারা শহর সচল রাখতে পারে। সে কর্তব্যের ডাকেই হোক বা আদালতের নির্দেশে।
রাস্তার ধারে ব্যারিকেড করে চলছে রান্নাবান্না। সোমবার সকালে। —নিজস্ব চিত্র।
আগামী বছরের বিধানসভা ভোটের আগে সোমবার ছিল তৃণমূলের শেষ বাৎসরিক সমাবেশ। এই সমাবেশে শাসক শিবির যেমন তাদের শক্তিপ্রদর্শন করে, তেমনই নিজেদের সাংগঠনিক শক্তিও ঝালিয়ে নেয়। বাম আমলে সিপিএম এই বিষয়টি নিশ্চিত করত মাঝেমধ্যে বাংলা বন্ধ ডেকে। কিন্তু তৃণমূলের আমলে ‘কর্মনাশা বন্ধ’ বিদায় নিয়েছে। তাদের রয়েছে ২১ জুলাইয়ের শহিদ সমাবেশ। আশ্চর্য নয় যে, প্রতি বারই এই সমাবেশের বহর তার আগের বারকে ছাপিয়ে যায়। বক্তৃতা করতে গিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সেটা বলেও দিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘এ বছর ২১ জুলাইয়ের ভিড় গত বছরকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। অবশ্য এটাই প্রতি বছরের ২১ জুলাইয়ের বৈশিষ্ট্য। আগের বারের ভিড়কে ছাপিয়ে যাওয়া।’’ অভিষেক যা বলেননি, এ বারের ভিড় গত বারকে না-ছাপালে চোখে লাগত। কারণ, ২০২৬ সালের বিধানসভা ভোট। তার আগে রাজ্য জুড়ে শক্তিপ্রদর্শনের এটাই ছিল সুযোগ। ফলে দলের নেতা-নেত্রীরাও দ্বিগুণ, তিন গুণ উৎসাহ নিয়ে লোক এনেছেন সমাবেশে।
সেই কারণেই কলকাতা পুলিশের কাজ কঠিন ছিল। তা কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায় আদালতের নির্দেশে। আদালত জানিয়েছিল, সোমবার সকাল ৮টার মধ্যে সমস্ত মিছিল শেষ করে ফেলতে হবে। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে কোনও মিছিল করা যাবে না। মিছিলে রাশ টানতে হবে। যাতে জনতার দুর্ভোগ না-হয়। একে কাজের দিন, তায় সপ্তাহের শুরু। তৃণমূলের সমাবেশের কারণে নিত্যযাত্রীদের যাতে ভোগান্তির মুখে না-পড়তে হয়, পুলিশকে তা নিশ্চিত করতে বলেছিল কলকাতা হাই কোর্ট। বেলা ১১টার পর দেখা গেল, হাই কোর্টের সেই ‘পরীক্ষা’য় সসম্মানে পাশ করেছে কলকাতা পুলিশ। সোমবার সকালে আদালত বসার পরে পুলিশের কাজের প্রশংসা করেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ। তিনি বলেন, ‘‘ভাল ভাবে যান নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। পুলিশ কাজ করেছে।’’
তখন আদালতে এক আইনজীবী জানান, অন্যান্য দিন নিউ আলিপুর থেকে হাই কোর্টে পৌঁছোতে তাঁর ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে। সোমবারও তা-ই লেগেছে। তখন বিচারপতি ঘোষ জানান, স্বাভাবিক সময়ই লেগেছে। রাস্তায় ট্র্যাফিকের কোনও সমস্যা নেই। বস্তুত, সভা শুরু হওয়ার আগের মতোই সভা ভাঙার পরেও কলকাতা, বিশেষত মধ্য কলকাতায় যানজট নজরে পড়েনি। রাস্তায় প্রচুর পরিমাণে পুলিশ সকাল থেকেই ছিল।
মৌলালির কাছে সোমবার সকালে বাসের অপেক্ষায় নিত্যযাত্রীরা। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। —নিজস্ব চিত্র।
তবে অনেকে বলছেন, পরোক্ষে হলেও অন্তত তিনটি বিষয়ে কলকাতা পুলিশ সুবিধা পেয়েছে। প্রথমত, তৃণমূলের সমাবেশের জন্য রাস্তায় সাধারণ যানবাহন অনেক কম ছিল। অনেকে রাস্তায় বেরিয়ে যানবাহন পাননি। প্রাইভেট কারের সংখ্যাও ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় কম। খুব সহজে মেলেনি অ্যাপ ক্যাবও। তবে মেট্রো পরিষেবা স্বাভাবিক থাকায় সেখানে সারা দিন অতিরিক্ত ভিড় হয়েছে। যাঁরা পথে আটকে পড়ার শঙ্কা করেছিলেন, তাঁরা মেট্রো ধরে গন্তব্যে বা তার কাছাকাছি গিয়েছেন। তবে মেট্রোয় এমনিতেই সপ্তাহের শুরুতে অফিসের সময়ে বাড়তি ভিড় থাকে। সোমবারের পরিস্থিতি একটু ঘোরালো ছিল।
নিত্যযাত্রীদের একাংশের দাবি, ভিড়ের চাপে প্রতি স্টেশনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় দাঁড়িয়ে থেকেছে মেট্রো। দরজা বন্ধ করতেও সময় লেগেছে। দ্বিতীয়ত, সমাবেশমুখী মিছিলে আটকে পড়তে পারেন ভেবে অনেকেই বাড়ি থেকে বেরোননি। বিশেষত, যাঁদের কর্মস্থল সভাস্থলের আশপাশে মধ্য কলকাতায়। তৃতীয়ত, সমস্ত মিছিলেরই অভিমুখ ছিল ধর্মতলার মোড়ের দিকে। কোনও মিছিল অন্য কোনও মিছিলে আড়াআড়ি ভাবে মেশেনি বা উল্টো দিক থেকেও আসেনি। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মিছিল এলেও সেগুলি একই অভিমুখে হয়েছে। যেখানে আর এগোনো যায়নি, সেখানে মিছিলকারীরা দাঁড়িয়ে পড়েছেন। যা সভাস্থলের পাঁচ-সাত কিলোমিটারের ব্যাসের মধ্যেই হয়েছে।
জোড়াসাঁকোর সামনে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউতে যান চলাচল সচল। —নিজস্ব চিত্র।
সমাবেশ উপলক্ষে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা কলকাতায় এসেছিলেন। অনেকে সোমবার সকালে এসেছেন। কেউ কেউ আবার রবিবার রাত থেকেই ধর্মতলায় বসে ছিলেন। হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে বিশাল দু’টি মিছিল ধর্মতলার দিকে রওনা দিয়েছিল। উত্তর এবং দক্ষিণ কলকাতা থেকেও বড় মিছিল এসেছিল ধর্মতলায়। সকাল থেকেই গার্ডরেল দিয়ে ধর্মতলার সভাস্থলে যাওয়ার একাধিক রাস্তা আটকে দিয়েছিল পুলিশ। পরিবর্তে অন্য রাস্তা দিয়ে বাস এবং বাকি গাড়ি ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফলে বড় কোনও সমস্যা বা বিশাল যানজট হয়নি। সার সার গাড়ি থাকলেও সেগুলি নড়াচড়া করেছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে রাস্তার উপরে তৃণমূলের মঞ্চ থাকায় যানবাহনের গতি মন্থর হয়েছে। কিন্তু শহর স্তব্ধ হয়নি কখনও। সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টার মধ্যে রাস্তায় মিছিলও দেখা যায়নি সে ভাবে। তবে রাস্তার পাশে সার দিয়ে বাস দাঁড়িয়েছিল। শিয়ালদহ থেকে মৌলালির রাস্তায় ব্যারিকেড করে রান্নাবান্নাও করেছেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা। পাত পেড়ে চলেছে খাওয়াদাওয়া।
শিয়ালদহের কাছে সোমবার সকালের ট্র্যাফিক পরিস্থিতি। —নিজস্ব চিত্র।
তবে ভোগান্তি থাকলেও তা রাস্তায় যানজটের কারণে হয়নি। নিত্যযাত্রীরা তা-ও মেনে নিয়েছেন। হাই কোর্টের নির্দেশ মেনে শহরকে নির্দিষ্ট সময়ে মিছিল এবং যানজট থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছে পুলিশ। কলকাতার পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মার বাহিনী দেখিয়েছে, তারা পারে। যদিও সন্দিগ্ধরা বলছেন, ‘‘পারে। যদি আদালত বলে!’’