জীবনতলার মঠের দিঘি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নবজাতকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করছেন বিএমওএইচ হরিপদ মাঝি। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
আঁধারেই ছিল এই এলাকা। রোগ, মৃত্যু, অজ্ঞতার গাঢ় আঁধার। অন্ধকারের সেই উৎস থেকেই এখন ছড়িয়ে যাচ্ছে আলো।
‘প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব’ বড় ভারী কথা। সোজা বাংলায় তার মানে, হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে সন্তানের জন্ম দেওয়া। আর এখানেই সারা পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে সব চেয়ে পিছিয়ে ছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিং-২-এর প্রত্যন্ত জীবনতলা ব্লক। এক বছর আগেও সেখানে মাত্র ২৬ শতাংশ প্রসব হতো হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বাকিটা বাড়িতেই। প্রসব হতে গিয়ে বহু মহিলার মৃত্যু হতো। জন্মের পর-পরই শারীরিক নানা জটিলতায় মারা যেত অনেক নবজাতক। শিশুদের সামগ্রিক টিকাকরণের হারও ছিল তথৈবচ। গোটা রাজ্যের মুখে আক্ষরিক অর্থেই কালি লেপে দিয়েছিল এই ব্লক।
বরাবরের ফেল করা সেই ছাত্রই আজ নম্বরের ভেল্কি দেখাচ্ছে। মাত্র এক বছরেই জীবনতলায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ছাড়িয়েছে ৯০ শতাংশ! স্বাস্থ্যকর্তারা একেই এখন বলছেন ‘জীবনতলা মডেল’। তার সাফল্যের মন্ত্রটি রাজ্যের অন্যত্র ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এমনকী প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা দেশের অন্য রাজ্যগুলি কী ভাবে ‘জীবনতলা মডেল’ অনুসরণ করে এগোতে পারে, সে ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে দিল্লিতেও।
সরকার গঠনের গোড়া থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার বৃদ্ধিতে জোর দিয়ে আসছেন মমতা। তিনি ক্ষমতায় আসার পর এই হার আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েওছে। তা সত্ত্বেও এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে পিছিয়ে ছিল তিনটি জেলা— উত্তর দিনাজপুর, মালদহ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা।
মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে ২০১৫-র অগস্টে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেই চালু হয় একটি বিশেষ স্বাস্থ্য প্রকল্প, মুখ্যমন্ত্রী যার নাম রাখেন ‘আনন্দী’। বাজিমাত করেছে সেই প্রকল্পই। তার ছোঁয়াতেই ‘বটম থ্রি’-র লজ্জা থেকে মুক্তি ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার। গোটা জেলায় এখন প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের হার ৮৫ শতাংশ। আর ৯০ শতাংশের গণ্ডি পেরিয়ে সেই মুকুটেই রত্ন হয়ে উজ্বল জীবনতলা।
মূলত যাঁর হাত ধরে জীবনতলায় আনন্দী প্রকল্প ডানা মেলছে, তিনি ব্লক স্বাস্থ্য আধিকারিক (বিএমওএইচ) হরিপদ মাঝি। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এলাকায় হরিপদবাবুর আদি বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। তাঁদের আট ভাইবোনের প্রত্যেকেরই জন্ম হয়েছিল বাড়িতে, দাইয়ের হাতে। বাঘের কামড়ে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর দাদার। বাঘে ধরেছিল বাবাকেও, বরাতজোরে বেঁচে যান তিনি। বিষক্রিয়ায় বিনা চিকিৎসায় কাতরাতে কাতরাতে মারা গিয়েছিলেন হরিপদবাবুর দিদি। ‘‘শৈশবের এই প্রত্যেকটি ঘটনাই আমাকে একটু একটু করে ডাক্তার হওয়ার দিকে এগিয়ে দিয়েছিল। ডাক্তার হওয়ার পরেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, মা ও শিশুর মৃত্যু-হার কমাতে যতটুকু সাধ্য, আমি করব’’— জীবনতলার মঠের দিঘি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ব্যস্ততার ফাঁকে বলছিলেন হরিপদবাবু।
কী ভাবে এমন অভাবনীয় কাহিনি লিখলেন তাঁরা?
জেলার স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, আনন্দী প্রকল্প রূপায়ণ করতে গিয়ে কোনও বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করতে হয়নি। বরং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের উজ্জীবিত করার দিকটিতেই বেশি জোর দিয়েছিল প্রশাসন। কর্তাদের মনে হয়েছিল, প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের ক্ষেত্রে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেহাল দশার অন্যতম প্রধান কারণ সেটাই। সবিস্তার খোঁজ নিয়ে তাঁরা জেনেছিলেন, ওই এলাকার ‘আশা’ (অ্যাক্রেডিটেড সোশ্যাল হেলথ অ্যাক্টিভিস্ট) কর্মীরা বহু ক্ষেত্রেই প্রসূতিদের বাড়িতে যাচ্ছেন না। অথচ প্রসূতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা থেকে শুরু করে সচেতনতার প্রসার— গ্রামাঞ্চলে এই কাজটা তাঁদেরই করার কথা। অন্তঃসত্ত্বা হওয়া থেকে শুরু করে সন্তানের জন্ম পর্যন্ত গ্রামের মায়েদের ভার কার্যত থাকার কথা তাঁদের হাতেই। কিন্তু সেই কর্মীরাই নানা কারণে বাড়ি-বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় প্রসূতিদের হাসপাতালে আসতে উদ্বুদ্ধ করার কেউ ছিল না। এর সঙ্গে চেপে বসেছিল গ্রামবাসীদের অজ্ঞতা। গয়ংগচ্ছ মনোভাব ছিল এলাকার ডাক্তার, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের একাংশের মধ্যেও।
এই পরিস্থিতির বদল ঘটাতেই ঘন ঘন প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় গিয়ে বৈঠক শুরু করেন জেলার শীর্ষ কর্তারা। বোঝাতে থাকেন, ‘হচ্ছে-হবে’ মনোভাবের পরিণতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা ছাড়াও আলোচনায় সামিল করা হয় পঞ্চায়েত সদস্য, ধর্মীয় সংস্থার প্রধান, স্কুলশিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতিনিধিদেরও। এর পাশাপাশি আনন্দী প্রকল্পের আওতাতেই জেলাশাসকের উদ্যোগে চালু হয় এক অভিনব ব্যবস্থা। তাঁর ব্যক্তিগত সই করা চিঠি পাঠানো শুরু হয় সমস্ত অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে। চিঠিতে সরাসরি আবেদন জানানো হয়, ‘হাসপাতালে এসে সন্তানের জন্ম দিন।’ আর ওই চিঠির শেষে রাখা হয় আলাদা একটি অংশ। সেখানে লেখা— ‘কথা দিলাম’। যাঁরা সরকারের আবেদনে সাড়া দিতে চান, ওই অংশে সই বা টিপসই দিয়ে অঙ্গীকার করানো হয় তাঁদের।
এখানেও কিন্তু শেষ নয়। জেলার স্বাস্থ্য কর্তাদের দফতর থেকে এর পর অন্তঃসত্ত্বা বা তাঁদের পরিবারের লোকদের ফোন করে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়, আদৌ ‘আশা’ কর্মীরা তাঁদের বাড়িতে গিয়েছেন কি না। এই ‘ক্রস ভেরিফিকেশন’-এ কাজ হয় ম্যাজিকের মতো। যে কর্মীরা যাননি. তাঁরা সতর্ক হন। কেন ‘আশা’ কর্মীদের কাজে অনীহা, তা জেনে নিয়ে তাঁদের সুযোগ-সুবিধে বাড়ানোরও ব্যবস্থা হয়।
সেই সঙ্গেই সংস্কার হয় হাসপাতাল-স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাড়িগুলির। লেবার রুমকে সংক্রমণ-মুক্ত করার ব্যবস্থা হয়। আসে নতুন পর্দা, বিছানার চাদর, গাউন। প্রসূতিদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আনতে বরাদ্দ গাড়ির সংখ্যা বাড়ানো হয়। যে সব প্রত্যন্ত জায়গায় চার চাকার গাড়ি ঢোকে না সেখানে তিন চাকা, এমনকী ব্যবস্থা হয় নৌকোরও। সব মিলিয়ে এক মাসেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসবের সংখ্যা বেড়ে যায় অনেকটাই। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই ইতিহাস।
আনন্দী প্রকল্পে রাজ্য সরকারকে প্রযুক্তিগত সহায়তা করেছে ইউনিসেফ। এ রাজ্যে ইউনিসেফ-এর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ কনীনিকা মিত্রের কথায়, ‘‘সন্তুষ্ট মা-ই হলেন সেরা বিজ্ঞাপন। একজন মা যদি হাসপাতালে এসে প্রসব করে নিশ্চিন্ত হন, তা হলে তিনিই তাঁর চারপাশে অন্যদের বলবেন। এ ভাবেই সংখ্যাটা বাড়বে।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক পি বি সেলিম বলছেন, ‘‘যে চিকিৎসক এবং অ-চিকিৎসক কর্মীদের অক্লান্ত চেষ্টায় এটা সম্ভব হল, তাঁদের বিশেষ স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এখন প্রত্যেকেই চাইছেন, কী ভাবে অন্য জেলাকে টেক্কা দিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। একটা সুস্থ প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই সাফল্যই প্রমাণ করে দিয়েছে, সদিচ্ছা থাকলে সব সম্ভব।’’ জেলাশাসকের এই প্রত্যয়েরই ছায়া জীবনতলার অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী জাবেদা বিবির চোখেমুখে। এক সময়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র-হাসপাতালে প্রসবের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন, প্রচার করেছেন টিকাকরণের, জোর দিয়েছেন দু’টি সন্তানের পরে বন্ধ্যাকরণের। এলাকার লোকেরাই তখন তাঁকে একঘরে করে দিয়েছিলেন। টানা পাঁচ মাস বাড়ি ফিরতে পারেননি জাবেদা। এলাকার মাতব্বরদের হাতে মার খেয়েছিলেন তাঁর স্বামী। তবু দমেননি জাবেদা। সেই জেদই আরও দৃঢ় হয়েছে আজ। জাবেদা, ‘আশা’ কর্মী জামেনা মোল্লারা একবাক্যে বলছেন, ‘‘আমরাই যে পরিস্থিতি বদলে দিতে পারি, এই এক বছরে তা বুঝতে পেরেছি। এখন আমাদের একটাই লক্ষ্য। বিনা চিকিৎসায় কোনও মা কিংবা শিশুকে আমরা শেষ হয়ে যেতে দেব না।’’