তৎপর পুলিশ। সৈকত থেকে বার করে দেওয়া হচ্ছে সব গাড়ি। সোমবার সোহম গুহের তোলা ছবি।
মাত্র তিন মাস আগে মন্দারমণির সৈকতে সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধে নির্দেশ দিয়েছিল জাতীয় পরিবেশ আদালত। কিন্তু নিয়ম যে মানা হচ্ছে না, চোখে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়ে দিয়েছে রবিবার ভোরে গাড়ির গতির খেলায় তিন তরুণের মৃত্যু।
এই দুর্ঘটনাকে সামনে রেখেই এ বার পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রশাসনকে কার্যত ভর্ৎসনা করল কলকাতার জাতীয় পরিবেশ আদালতের বিচারপতি এস পি ওয়াংদি এবং বিশেষজ্ঞ-সদস্য পি সি মিশ্রের ডিভিশন বে়ঞ্চ। মন্দারমণির দূষণ সংক্রান্ত মামলার শুনানিতে সোমবার ক্ষুব্ধ ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশ, গত ৩১ মে সৈকতে গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করার পরেও কী ভাবে গাড়ি সৈকতে নামল, জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারকে তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। সৈকতে গাড়ি চালানো বন্ধ না করার পিছনে কার গাফিলতি রয়েছে এবং সে ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাও হলফনামা দিয়ে জানাতে বলা হয়েছে। মামলার আবেদনকারী বিষ্ণুপদ পাখিরার আইনজীবী সোমনাথ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে কার গাফিলতি, সেটাই জানতে চেয়েছে আদালত।’’
পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমলের প্রতিক্রিয়া, ‘‘পরিবেশ আদালতের নির্দেশ এখনও জানি না। তবে সৈকতে যাতে গাড়ি না নামে তাই বিকল্প রাস্তা হচ্ছে। জমি সমস্যায় রাস্তার কাজে দেরি হয়েছে।’’ তবে নিষেধাজ্ঞা কার্যকরে পুলিশ-প্রশাসনের গাফিলতি মেনেই কার্যত এ দিন ‘ক্লোজ’ করা হয়েছে মন্দারমণি থানার ওসি রাজা মণ্ডলকে। নতুন ওসি-র দায়িত্ব নিয়েছেন কাঁথি থানার সাব-ইন্সপেক্টর পার্থ বিশ্বাস। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া বলেন, ‘‘ওই ওসি-কে পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়েছে।’’
রবিবারের দুর্ঘটনার পরে এ দিন মন্দারমণির সৈকতে নজরদারিও ছিল আঁটোসাঁটো। সকাল থেকে মোতায়েন ছিল বিশাল পুলিশবাহিনী। দুপুর পর্যন্ত নজরদারিতে ছিলেন খোদ কাঁথির এসডিপিও ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়। বেলাভূমিতে নামার রাস্তায় বসেছে ব্যারিকেড। এ দিন তাই বালির বুকে গাড়ি চলাচল সেভাবে হয়নি। শুধু আশপাশের গ্রামের লোকেদের যাতায়াতের জন্য সৈকতে ট্রেকার চলাচলের অনুমতিটুকু দিয়েছে প্রশাসন। আর সৈকত লাগোয়া হোটেলগুলির কিছু গাড়িকে বার করে দেওয়া হয়েছে বেলাভূমির উপর দিয়ে।
যে গাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষে বৈভব শাণ্ডিল্য, সুরজ দাশগুপ্ত ও শিবরাজ নস্করের মৃত্যু হয়েছে, সেই বিএমডব্লু-র চালক দীপেশ রঞ্জনকে এ দিন গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। দুর্ঘটনায় জখম দীপেশের বিরুদ্ধে বেপরোয়া গাড়ি চালানো ও অনিচ্ছাকৃত খুনের ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। তবে কাঁথি আদালতে হাজির করা হলে আদতে রাঁচির বাসিন্দা দীপেশ দু’হাজার টাকার বন্ডে জামিন পেয়ে যান। পুলিশ সূত্রে খবর, মৃতদের পরিবারের তরফে অভিযোগ দায়ের না হওয়ায় মামলা কিছুটা দুর্বল হয়েছে। জেলার পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়ারও বক্তব্য, ‘‘আমরা অনুরোধ করলেও মৃত তিন তরুণের পরিজনেরা অভিযোগ করতে রাজি হননি। স্থানীয় এক যুবকের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত হচ্ছে।’’
ঘটনার পরই অভিযোগ উঠেছিল, বৈভবরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রচণ্ড জোরে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। পুলিশ সূত্রে খবর, ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টেও তারই সমর্থন মিলেছে। তা ছাড়া, রবিবার খোদ পুলিশ সুপার জানিয়েছিলেন, বৈভবদের গাড়িতে গাঁজার প্যাকেট মিলেছে। কাঁথির এসডিপিও এ দিন জানান, ওই প্যাকেট পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে।
তবে সব ছাপিয়ে চর্চার কেন্দ্রে সেই প্রশাসনিক গাফিলতি। স্থানীয় বাসিন্দা থেকে পরিবেশকর্মী, সকলেরই বক্তব্য— নজরদারির ফাঁক গলেই চলছে নিয়ম ভাঙা। আসলে তটভূমি দিয়ে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর মজা নিতেই একাংশ পর্যটকে মন্দারমণিতে আসেন। এর পিছনে স্থানীয় হোটেল ব্যবসায়ীদের একাংশের মদত রয়েছে বলে অভিযোগ। নিউ জলধার মৎস্যজীবী শ্রীকান্ত বরের অভিযোগ, ‘‘এখানে বহু হোটেল পাট্টার জমিতে তৈরি হয়েছে। প্রশাসনের কাছে তার তালিকা থাকলেও ভাঙা হয়নি।’’ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়েরও মত, ‘‘রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন আর আইন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরিণতিতেই মন্দারমণির সৈকত ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকার নীরব দর্শক।’’
রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনস্থ ‘ইন্টার-গভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ (আইপিসিসি)-সহ একাধিক পরিবেশ গবেষণা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, বিশ্ব উষ্ণায়ন ও জলবায়ু বদলের ফলে বিপন্ন হবে উপকূলীয় এলাকা ও তার জনজীবন। কেন্দ্রীয় সরকার তাই উপকূলীয় পরিবেশবিধি কঠোর করেছে। কিন্তু সেই বিধি ভেঙেই মন্দারমণিতে মাথা তুলছে হোটেল, রিসর্ট। এ ক্ষেত্রে রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ভূমিকায় এ দিন অসন্তোষ প্রকাশ করেছে জাতীয় পরিবেশ আদালত। বেআইনি হোটেলের বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে।
শুধু দুর্ঘটনা নয়, বালুতটে গাড়ি চলানোয় নষ্ট হচ্ছে জীব বৈচিত্র্যও। পরিবেশবিদদের মতে, এ জন্যই একদা মন্দারমণির আকর্ষণ লাল কাঁকড়া হারাতে বসেছে। ভাঙছে বেলাভূমি। রাজ্য পরিবেশ দফতরের প্রাক্তন বিজ্ঞানী সোমনাথ ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘তটভূমির উপর দিয়ে যত গাড়ি চলবে, ততই তা ভঙ্গুর হবে। বাড়বে বিপদ।’’