নেতাদের ‘কলম’যোগ কবুল ইমরানের

সারদার ‘কলম’ দৈনিকে রাজ্যের শাসক দলের শীর্য কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর যোগাযোগ নিয়ে তৃণমূলের সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি জানাল সিবিআই। শুক্রবার সিবিআই ভবনে হাজির হওয়ার পরে প্রায় দু’ঘণ্টা জেরা করা হয় পত্রিকাটির প্রাক্তন মালিক-সম্পাদক ইমরানকে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৫ ০৪:০৪
Share:

সিবিআইয়ের দফতরে আহমেদ হাসান ইমরান। ছবি: সুমন বল্লভ।

সারদার ‘কলম’ দৈনিকে রাজ্যের শাসক দলের শীর্য কয়েক জন নেতা-মন্ত্রীর যোগাযোগ নিয়ে তৃণমূলের সাংসদ আহমেদ হাসান ইমরান গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি জানাল সিবিআই। শুক্রবার সিবিআই ভবনে হাজির হওয়ার পরে প্রায় দু’ঘণ্টা জেরা করা হয় পত্রিকাটির প্রাক্তন মালিক-সম্পাদক ইমরানকে।

Advertisement

সিবিআই সূত্রের খবর, সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনকে সংবাদপত্রটি বিক্রি করা নিয়ে ইমরানকে দশ-বারোটি প্রশ্ন করা হয়, যার অনেকগুলির জবাবই তিনি দিতে পারেননি। একই সঙ্গে, সারদা ঝাঁপ গুটোনোর পরেও কী ভাবে কলম এখনও প্রকাশিত হচ্ছে, কোথা থেকে অর্থ আসছে— সে বিষয়েও ইমরানকে প্রশ্ন করা হয় বলে সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে। উত্তর দিতে গিয়ে ইমরান রাজ্যের এক মন্ত্রীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্বীকার করেন বলে কেন্দ্রীয় এই গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্তা জানিয়েছেন। শাসক দলের মাথারা কী ভাবে এই সংবাদপত্রটি পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ও রয়েছেন, ইমরান তা-ও জানিয়েছেন সিবিআই-কে।

ইমরান যদিও দাবি করেছেন, সিবিআইকে তিনি কোনও স্বীকারোক্তি দেননি। আনন্দবাজারকে তিনি বলেন, ‘‘কলম সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন আমাকে করা হয়। আমি তার সাধ্যমতো জবাব দিয়েছি। তবে কোথাও সইসাবুদ করিনি। তাই স্বীকারোক্তির প্রশ্নই উঠছে না।’’ কিন্তু সিবিআইয়ের ওই কর্তা সেই দাবি উড়িয়ে জানিয়েছেন— ইমরানকে জানিয়েই তাঁর জেরাপর্ব পুরোটা ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে। রীতি অনুযায়ী জেরার লিখিত প্রতিলিপি তাঁকে দিয়ে সইও করানো হয়েছে, যাতে ওই নেতা-মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ইমরানের বক্তব্য আদালতে সাক্ষ্য হিসেবে পেশ করা যায়।

Advertisement

সুদীপ্ত সেন সিবিআইয়ের কাছে লিখিত অভিযোগে জানিয়েছেন, শাসক দলের চাপেই কলম পত্রিকাটি তাঁকে কিনতে হয়েছিল। সাপ্তাহিক পত্রিকাটি দৈনিক হিসেবে চালাতে কয়েক দফায় তিনি প্রায় ১৬ কোটি টাকা ঢেলেছিলেন। কিন্তু টাকা নিয়েও সেটির পুরনো মালিক ইমরান শেষ পর্যন্ত তাঁকে মালিকানা হস্তান্তর করেননি। উল্টে ভয় দেখিয়ে, চাপ দিয়ে আরও টাকা দাবি করছিলেন। এই অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে ইডি (এনফোর্সমেন্ট ডাইরেক্টরেট) ইমরানের কাছে বিক্রির দলিল ও অন্য নথিপত্র চায়। তাঁকে এক দফা জেরাও করা হয়। অভিযোগ, তৃণমূলের এই সাংসদ যে দলিল ইডি-র কাছে পেশ করেন, তাতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। বিক্রি থেকে পাওয়া টাকার অঙ্কটিও সাদা কালি দিয়ে মোছা হয়েছে।

পরে সিবিআই বিষয়টির তদন্তে নেমে ইমরানের বয়ানে আরও অসঙ্গতি খুঁজে পায়। সে সময়ে তাঁকে জেরার জন্য ডাকাও হয়। কিন্তু সাংসদ হিসেবে ব্যস্ততার যুক্তি দেখিয়ে তিনি সিবিআই দফতরে আসেননি। আইনজীবীকে দিয়ে কিছু নথি পাঠিয়ে দেন। দিন কয়েক আগে সিবিআই এই সাংসদের আইনজীবীকে চিঠি দিয়ে কিছু প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য ইমরানকে দফতরে ডাকে। ইমরান যদিও দাবি করছেন, সিবিআই কোনও সমন পাঠায়নি। তিনি নিজে থেকেই তাদের দফতরে গিয়েছেন। ইমরান বলেন, ‘‘তদন্তে সহযোগিতা করার জন্য আমিই নিজে সিবিআইয়ের কাছে গিয়েছি। সাধ্যমতো তাঁদের প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। তাঁদের আরও কিছু জানার থাকলে আমার আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেছি।’’ সিবিআইয়ের ওই কর্তা ইমরানের এই দাবির জবাবে ঠাট্টা করে বলেন, ‘‘আমাদের দফতরটা তো বেড়ানোর জায়গা নয়, যে তিনি বেড়াতে এসেছিলেন! আমরা তাঁকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম বলেই তাঁকে আসতে হয়েছিল।’’ তিনি জানান, ইমরানকে জেরার জন্য সিবিআই অফিসারেরা গত তিন দিন ধরে ‘কলম’ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য ঘাঁটাঘাটি করে তৈরি হয়েই ছিলেন। অনেক প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারেননি এই সাংসদ। তাই তাঁকে আবার আসতে বলা হয়েছে।

কী কী প্রশ্নের জবাব ইমরান দিতে পারেননি? সিবিআই সূত্র বলছে, মোট পাঁচটি প্রশ্নের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি এই সাংসদ। এক, টাকা নিয়েও সারদা মিডিয়ার হাতে ‘কলম’ সংবাদপত্রটির মালিকানা দেওয়া হয়নি কেন? দুই, সারদা-কর্তা জানিয়েছেন নতুন এই দৈনিকটিতে ১৬ কোটি টাকা ঢালা হয়েছিল। কলম-এক ম্যানেজার আলি আকবরও শ্যামল সেন কমিশনের কাছে টাকার এই অঙ্কের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু ইমরান ইডি-কে জানিয়েছিলেন, সুদীপ্ত সেন তিন-চার কোটি টাকা ঢেলেছিলেন। সিবিআইয়ের প্রশ্ন— বাকি টাকা কোথায় গেল? বিজ্ঞাপন বাবদ বকেয়া টাকা পরে তোলা হলেও কেন তা কলম-এর তহবিলে জমা পড়েনি? তিন, সারদা মিডিয়ার আর একটি উর্দু সংবাদপত্র ‘আজাদ হিন্দ’-এর কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে তাঁর নিয়োগ হলেও কেন ‘কলম’-এ কার্যকরী সম্পাদক হিসেবে তিনি নিজের নাম ছাপতেন? চার, ইডি-কে যে বিক্রির চুক্তিপত্রের কপি তিনি দিয়েছেন, তাতে টাকার অঙ্কটি কেন সাদা কালি দিয়ে মোছা? এবং পাঁচ, সারদা ঝাঁপ গোটানোর পরে তার টাকায় কেনা দামী দামী কম্পিউটার ও ক্যামেরাগুলি কোথায় গেল?

সিবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, এই সব প্রশ্নের জবাব না-পেলে তৃণমূল সাংসদের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, টাকা নয়ছয় ও প্রতারণার অভিযোগ এনে শীঘ্রই আইনি ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থা। শুধু এই অভিযোগগুলিই নয়, ইমরানকে এ দিন জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘কলম’ চালানোর বিষয়ে তিনি যে আর্থিক হিসেব ইডি-কে দিয়েছেন, ব্যাঙ্কে লেনদেনের সঙ্গে তা একেবারেই মিলছে না। সারদার টাকা বাংলাদেশে জামাতে ইসলামির নেতাদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার যে অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে উঠেছে, সে বিষয়েও এ দিন ইমরানকে জেরা করা হয়েছে বলে সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে।

তৃণমূলের এই সাংসদের জঙ্গিযোগ নিয়ে অনেক অভিযোগ রয়েছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন সিমি-র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এই ইমরান। তবে ইমরানের দাবি, সংগঠনটি নিষিদ্ধ হওয়ার পরে তিনি আর সেটির সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। কিন্তু কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী, সিমি নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও কলকাতায় জঙ্গিদের আশ্রয় দিয়েছেন বাংলাদেশের জামাতে ইসলামির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা ইমরান।

নবান্ন সূত্রের খবর— রাজ্যসভায় তৃণমূল ইমরানকে প্রার্থী ঘোষণা করার পরে তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অনিল গোস্বামী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করে তাঁকে সিদ্ধান্ত বদলের অনুরোধ করেন। কিন্তু মমতা সিদ্ধান্ত বদলাননি। বাংলাদেশ সরকার ইমরানের সঙ্গে মৌলবাদীদের যোগাযোগের অভিযোগ জানিয়ে দিল্লির কাছে সরকারি রিপোর্ট পাঠায়। ইমরানের বিষয়ে তাদের আপত্তির কথাও জানিয়েছিল ঢাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন