ঘটা করে মাতৃত্ব দিবস, প্রসূতি মৃত্যুতে রাশ নেই

কয়েক মাস আগের ঘটনা। খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে এক প্রসূতির মৃত্যু ঘিরে ধুন্ধুমার বেধেছিল। মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, ওই প্রসূতিকে সময় মতো রক্ত দেওয়া যায়নি।

Advertisement

বরুণ দে

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৩:২৩
Share:

কয়েক মাস আগের ঘটনা। খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে এক প্রসূতির মৃত্যু ঘিরে ধুন্ধুমার বেধেছিল। মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা গিয়েছিল, ওই প্রসূতিকে সময় মতো রক্ত দেওয়া যায়নি। কারণ, তাঁর যে গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন ছিল, তখন কোনও হাসপাতালেই সেই গ্রুপের রক্ত মজুত ছিল না। প্রয়োজনীয় গ্রুপের রক্ত যখন জোগাড় হয়, ততক্ষণে প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে।

Advertisement

এটা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নানা কারণে জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে অহরহ ঘটছে প্রসূতি মৃত্যু। সন্তান জন্মানোর সময় ঝুঁকি এড়াতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। সে জন্যই আশাকর্মী নিয়োগ, নিশ্চয় যানের ব্যবস্থা, প্রচুর টাকা খরচ করে একের পর এক হাসপাতালে পরিকাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে উন্নত চিকিৎসা পরিষেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বারবার। কিন্তু সে সব ফাঁকা বুলি হয়েই থেকে গিয়েছে। প্রসূতি মৃত্যুর হারে রাশ টানা যায়নি। শনিবারই জেলায় উদ্‌যাপন করা হয়েছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। পদযাত্রা থেকে সচেতনতামূলক আলোচনাসভা, আয়োজনে খামতি ছিল না। নিরাপদ মাতৃত্ব, নিরাপদ প্রসবের নানা দিক নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এ সবের পরেও জেলায় প্রসূতি মৃত্যুর পরিসংখ্যান রীতিমতো উদ্বেগজনক।

গত চার বছরের পরিসংখ্যান বলছে, জেলায় বছরে গড়ে ৫৬ জন প্রসূতির মৃত্যু হয়। এর মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় মৃত্যুর ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনই অনেকে মারা গিয়েছে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময়। রাজ্যে প্রতি এক লাখে প্রসূতি মৃত্যুর হার ১১৩। এই জেলায় কোনও বছরে ৮০ হাজার, কোনও বছরে তার থেকেও বেশি শিশুর জন্ম হয়। পরিসংখ্যান সামনে এনে জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তার যুক্তি, যেখানে বছরে ৭০ থেকে ৮০ হাজার শিশু জন্মাচ্ছে, সেখানে ৫০-৬০ জন প্রসূতির মৃত্যু খুব একটা বেশি নয়। তবে ওই স্বাস্থ্য কর্তা সংখ্যাতত্ত্বের মারপ্যাঁচ দিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, জেলায় এখনও প্রসূতি মৃত্যুতে লাগাম টানা যায়নি।

Advertisement

প্রসূতি মৃত্যুতে হামেশাই চিকিৎসার অবহেলার অভিযোগ ওঠে। শোরগোল পড়ে। পরিস্থিতি দেখে নতুন কমিটিও গড়া হয়েছে। যে কমিটি প্রসূতি মৃত্যুর পর্যালোচনা করে। পরিবারের তরফে অভিযোগ হোক কিংবা না হোক, হাসপাতালে কোনও প্রসূতির মৃত্যু হলে ওই কমিটি তার পর্যালোচনা করে। ঠিক কী কারণে প্রসূতির মৃত্যু হল তা খোঁজার চেষ্টা করে। গত বছর থেকে এই কমিটি জেলায় কাজও শুরু করেছে। তাও পরিস্থিতির বিশেষ হেরফের হয়নি।

এত কিছুর পরেও কেন পশ্চিম মেদিনীপুরে প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো যাচ্ছে না? জবাব এড়িয়ে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরার দাবি, ‘‘জেলায় প্রসূতি মৃত্যুর হার আগের থেকে অনেক কমেছে।’’ তবে জেলার অন্য এক স্বাস্থ্য-কর্তা মানছেন, ‘‘অনেক সময় প্রসূতির শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ থাকে। অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। তখন আর কিছু করার থাকে না!’’

রোগীর পরিবারের লোকেদের বক্তব্য অবশ্য অন্য। রোগীর পরিজনদের বক্তব্য, একাংশ ডাক্তার চিকিৎসাশাস্ত্র এবং চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে চলেন না। তাই প্রসূতিকে ভুগতে হয়। যে কোনও অস্ত্রোপচার তো জটিল হতেই পারে। তবে একাংশ ডাক্তার সব সময় সতর্ক থাকেন না। তাই বিপত্তি ঘটে। প্রসূতির প্রাণ যায়।

ঠিক কী কী কারণে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে? ডাক্তারদের একাংশ জানাচ্ছেন, রক্তপাত, গর্ভপাত, সংক্রমণ, উচ্চ-রক্তচাপ প্রভৃতি কারণে প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

পাশাপাশি, চিকিৎসার গাফিলতিতেও অনেক সময় প্রসূতি মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। জেলার এক স্বাস্থ্য কর্তা বলেন, ‘‘এখন প্রসূতি মৃত্যু হলে তার পর্যালোচনা হয়। এর ফলে কোথাও সামান্য ভুল হয়ে থাকলে তা ধরা পড়ে। পরবর্তী সময় একই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।’’ তাঁর দাবি, পর্যালোচনার ফলে বেশ কিছু দিকও সামনে আসছে।

এই পরিস্থিতিতে চলতি বছরে জেলায় প্রসূতি মৃত্যুর হার ফের ৫০-এর নীচে নামিয়ে আনা যাবে বলে স্বাস্থ্য দফতরের আশা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন