মুক্তির সূর্য দেখতে চান শতায়ু আজগর

এই দিনটিরই অপেক্ষা করে আছেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে। ভেঙেছে মন, ভেঙেছে শরীর। ক্ষীণ হয়ে এসেছে চোখের দৃষ্টি। তাই সারা জীবন ধরে পুষে রাখা স্বপ্নপূরণের শেষধাপে এসে এখন আর যেন তর সইছেনা। সময় যেন মনে হচ্ছে স্থবির। লাঠি হাতে সারাক্ষণ ছটফট করে বেড়াচ্ছেন দাওয়া থেকে উঠোনের ছোট্ট গণ্ডিতে। এক নাগাড়ে কথা বলতে পারেন না আর।

Advertisement

নমিতেশ ঘোষ

দিনহাটা শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

আজগর আলি। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব।

এই দিনটিরই অপেক্ষা করে আছেন তিনি। বছরের পর বছর ধরে। ভেঙেছে মন, ভেঙেছে শরীর। ক্ষীণ হয়ে এসেছে চোখের দৃষ্টি। তাই সারা জীবন ধরে পুষে রাখা স্বপ্নপূরণের শেষধাপে এসে এখন আর যেন তর সইছেনা। সময় যেন মনে হচ্ছে স্থবির। লাঠি হাতে সারাক্ষণ ছটফট করে বেড়াচ্ছেন দাওয়া থেকে উঠোনের ছোট্ট গণ্ডিতে। এক নাগাড়ে কথা বলতে পারেন না আর। কোনওমতে বলেন, “ঘুম আসে না আর। আর ঘুমোতেও চাই না। অন্তত পক্ষে ৩১ জুলাই ভোর পর্যন্ত। এই ছিটমহলে মুক্তির সূর্য দেখতে চাই।” কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলেন আজগর আলি, “এ জন্যই তো বেঁচে আছি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। প্রতিদিন তাঁর কাছে প্রার্থনা করতাম। মুক্তি না মেলা পর্যন্ত যেন আমাকে বাঁচিয়ে রাখেন তিনি।”
বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলে বয়োজ্যেষ্ঠ তিনিই। কোচবিহারের দিনহাটার বাংলাদেশি ছিটমহল মধ্য মশালডাঙার বাসিন্দা আজগর আলির বয়স এখন ১০৬। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহাল বিনিময় কমিটির তথ্য থেকে সেরকমই জানা গিয়েছে। আজ, শুক্রবার মধ্যরাতের অন্ধকারে স্বাধীনতার সূর্য উঠবে ছিটমহলগুলিতে। শনিবার সকাল ৯টায় ৫১টি ছিটমহলে একসঙ্গে ভারতীয় পতাকা তোলা হবে। শুক্রবার মধ্যরাত পর্যন্ত নানান অনুষ্ঠান হবে মধ্য মশালডাঙায়। বাড়িতে বাড়িতে বাসিন্দারাও তুলবেন ভারতের পতাকা। ওই দিন জাতীয় পতাকা তোলার ইচ্ছে রয়েছে আজগর আলির। অনুষ্ঠান মঞ্চের দিকে তাকিয়ে তিনি বলেন, “শুনছি অনেক মানুষ আসবেন। ওই মঞ্চে অনুষ্ঠান হবে। আমিও থাকতে চাই সেখানে।”
স্মৃতি যে এখন সবসময় বশে থাকে তা নয়, তবুও হাতড়ে হাতড়েই ফেলে আসা সময়কে ধরতে চেষ্টা করেন। জানান, তিনি যখন কিশোর সেই সময় মশালডাঙায় হাতে গোনা কিছু পরিবার বসবাস করত। চারদিকে খোলা মাঠ। চাষবাস করেই সংসার চালাতেন বাসিন্দারা। কোনও সীমা রেখা ছিল না। ধীরে ধীরে পাল্টে যায় সব। চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, “ভারত স্বাধীন হল। বাংলাদেশ স্বাধীন হল। আমরা স্বাধীনতা পেলাম না।” তখন ১৯৫৬ সাল। ওই এলাকা জুড়ে শুরু হয় গণ্ডগোল। তিনি পরিবার নিয়ে চলে যান বর্তমান বাংলাদেশের ভুরুঙ্গামারিতে। এরপর বাংলাদেশেও শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন ফের ফিরে আসেন মশালডাঙায়। সেই কষ্টের শুরু। বলেন, ‘‘চারদিকে উন্নয়ন হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল। ছিটমহলে কিছু নেই। ঠিক বুঝতে পারতাম না কী হচ্ছে। কেন হচ্ছে। কেন তাঁরা ছিটমহলের বাসিন্দা। ওই এলাকার বাইরেও বেরোতে দেওয়া হত না।’’

Advertisement

ধীরে ধীরে সব বুঝতে শুরু করেন। তারপর থেকেই স্বাধীনতা শব্দটা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত আজগর আলিকে। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ছিটমহলের জনসংখ্যা। আজগরের পরিবারও বড় হতে থাকে। ছেলে-মেয়ে নাতি-নাতনিদের নিয়ে আন্দোলনে নামেন তিনি। ২০০১ সালে ছিটমহলের আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু করে। আজগরের ছেলে বেলাল হোসেন, নাতি জয়নালরা সরাসরি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। বেল্লাল বলেন, “বাবা স্বাধীনতা দেখবেন বলে পণ করেছিলেন। আমরাও মনে প্রাণে চেয়েছি তিনি দেখে যান আমাদের মুক্তি। তাই হতে চলেছে। এর থেকে বেশি খুশি জীবনে আর কিছু নেই।”

আসগরের নাতি জয়নালও আন্দোলনে সামনের সারিতেই রয়েছেন। কলেজের তৃতীয় বর্ষের ওই ছাত্র বলেন, “দাদুর চোখের জল দেখতাম সব সময়। সব সময় স্বাধীনতার কথা বলতেন। যা দেখেই আন্দোলনে যোগ দিই। এখনও দাদু কাঁদেন। তবে তা আনন্দের কান্না।” আসগরের স্ত্রী জাবেদা বিবি এখন শয্যাশায়ী। ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির সহকারি সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, “আজগর আলি বলেন তাঁর এখন আর ঘুম আসে না। কখন সেই মুহূর্ত আসবে সেই অপেক্ষা ঘুমোতে দেয় না তাঁকে। আসলে এখন প্রহর গুনছেন ছিটমহলের মানুষ। আর সেই অপেক্ষাই ঘুম কেড়েছে ছিটমহলের প্রতিটি বাসিন্দার।”

Advertisement
(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন