পরপর ছুটি উপভোগ করুন, মঞ্জুলার উল্টো পথে মমতা

দু’জনেই রয়েছেন গণতন্ত্রের দু’টি স্তম্ভের শীর্ষে। দু’জনেই মহিলা। পশ্চিমবঙ্গে বিচারব্যবস্থার শীর্ষে যিনি রয়েছেন, তিনি ৬ মার্চ হোলির দিনে হাইকোর্টে আসছেন বলেই খবর। এবং তিনি চান, আইনজীবীরা ওই দিন হাইকোর্টে আসুন বা না আসুন, বিচারপতিরা যেন আসেন ও এজলাসে বসেন। আর প্রশাসনের শীর্ষে যিনি, তিনি দোল তো বটেই, হোলির দিনেও রাজ্যে ছুটি ঘোষণা করেছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৫ ০৩:২৪
Share:

বসন্ত সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত। বুধবার নজরুল মঞ্চে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

দু’জনেই রয়েছেন গণতন্ত্রের দু’টি স্তম্ভের শীর্ষে।

Advertisement

দু’জনেই মহিলা। পশ্চিমবঙ্গে বিচারব্যবস্থার শীর্ষে যিনি রয়েছেন, তিনি ৬ মার্চ হোলির দিনে হাইকোর্টে আসছেন বলেই খবর। এবং তিনি চান, আইনজীবীরা ওই দিন হাইকোর্টে আসুন বা না আসুন, বিচারপতিরা যেন আসেন ও এজলাসে বসেন।

আর প্রশাসনের শীর্ষে যিনি, তিনি দোল তো বটেই, হোলির দিনেও রাজ্যে ছুটি ঘোষণা করেছেন। বস্তুত, তাঁর সেই ঘোষণাকে ঢাল করেই হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন জানিয়ে দিয়েছে, হোলির দিনে আদালতে যাচ্ছেন না আইনজীবীরা।

Advertisement

যিনি বিচারব্যবস্থার প্রধান, তিনি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, হোলির দিন বন্ধ থাকলে ছুটির সময়ে পরে কোনও এক দিন খোলা থাকুক হাইকোর্ট।

প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের সেই প্রস্তাব পত্রপাঠ খারিজ হয়ে গিয়েছে।

আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবারও এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “কাল দোলের ছুটি আছে, পরশু আমরা হোলির ছুটি দিয়েছি। পরপর দু’দিন ভাল করে ছুটি উপভোগ করুন।”

ভুল হল, পরপর চার দিন!

বৃহস্পতিবারের দোল আর শনি-রবির মাঝখানে ক্যালেন্ডারের পাতায় বিষফোড়ার মতো জেগে ছিল হোলির শুক্রবারটা। মুখ্যমন্ত্রীতে তাতেই মলম লাগিয়ে দিলেন। ফলে বুধবারের পর রাজ্য সরকারের সমস্ত অফিসের ঝাঁপ খুলবে সেই সোমবারে। স্বভাবতই কর্মীদের মধ্যে খুশির হাওয়া।

সূত্রের খবর, হাইকোর্টের আইনজীবীদেরও একটা বড় অংশের আসল লক্ষ্য এই টানা চার দিনের ছুটি। চিঠিতে অবশ্য তাঁরা যুক্তি দিচ্ছেন, রাজ্য সরকারের ছুটি থাকায় বিভিন্ন সরকারি পদাধিকারী ৬ তারিখে হাইকোর্টে আসবেন না। ফলে কাজ চালানো দুষ্কর হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চই এর অনেক আগে স্পষ্ট করে দিয়েছিল, রাজ্য সরকার ছুটি দিলেও হাইকোর্ট চলবে তার নিজস্ব ক্যালেন্ডার মেনে।

আর নবান্নের ক্যালেন্ডার?

লাল রংটা তৃণমূল নেত্রীর ঘোর অপছন্দ হলেও তাঁর সরকারের ক্যালেন্ডারে ইতিমধ্যেই ‘লাল তারিখের’ ছড়াছড়ি। বিরোধীদের ডাকা বন্ধে সরকারি দফতর সচল রাখতে কর্মীদের অফিসে রাত্রিবাস পর্যন্ত করিয়ে কর্মসংস্কৃতির আশা জাগিয়েছিলেন যিনি, কালান্তরে তিনিই হয়ে উঠেছেন ছুটির কল্পতরু।

এমনিতে বাঙালির ক্যালেন্ডারে ছুটির অভাব নেই। তার উপরে ফি-বছর সেই তালিকায় নয়া সংযোজন করে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দুর্গাপুজোয় টানা ৯-১০ দিনের ছুটি উপহার দিতে ষষ্ঠী, দ্বাদশী এমনকী লক্ষ্মীপুজোর বিসর্জনেও ছুটি ঘোষণা করেছেন তিনি। ছুটি দিয়েছেন জামাইষষ্ঠীতে। এমনকী ছট, বুদ্ধপূর্ণিমা, নেপালি কবি ভানুভক্তের জন্মদিনেও ছিল ছুটি। উদ্দেশ্য যে বিভিন্ন সম্প্রদায়কে কাছে টানা, তা বলাই বাহুল্য।

এবং এই শেষোক্ত তালিকাও যে দীর্ঘতর হতে চলেছে, বুধবার কালীঘাটের ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডে ‘জয়হিন্দ ভবন’ নামে এক কমিউনিটি সেন্টারের উদ্বোধন করে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শিখ ধর্মাবলম্বীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “সামনেই তো আপনাদের বৈশাখী আসছে। আমরা এপ্রিলের ১৪-১৫ তারিখে নববর্ষ পালন করি আর আপনারা ১৩ তারিখে বৈশাখী উদ্যাপন করেন।”

ধরে নেওয়া যায়, ১৩ এপ্রিলও এ বার ঢুকে পড়ছে ছুটির ক্যালেন্ডারে। চলতি বছরে সে দিনটা সোমবার। সপ্তাহের প্রথম কাজের দিন। পয়লা বৈশাখ পড়েছে বুধবার, ১৫ এপ্রিল। মাঝে একটা দিন। মুখ্যমন্ত্রী যদি তাঁর রেওয়াজ মেনে সেই দিনটাও ছুটি ঘোষণা করে দেন, সোনায় সোহাগা!

কিন্তু বারবার অপ্রিয় প্রশ্নটাও ওঠে! রাজ্যের কর্মসংস্কৃতির কী হবে?

প্রশাসনের একাংশেরই আশঙ্কা, রাজ্যের গায়ে ‘শিল্পবিমুখ’ তকমা তো লেগেই গিয়েছে, এ বার ‘কর্মবিমুখ’ বিশেষণটাও বসতে দেরি নেই। সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেই দিলেন, “অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে, সরকারি দফতরে কাজকর্মের কোনও গুরুত্ব নেই।”

এক শিল্পকর্তা আরও চাঁছাছোলা। বললেন, “ছুটি দিলেও পরে কোনও এক শনিবার দফতর খোলা রেখে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত। তাতে ক্ষতিটা পুষিয়ে দেওয়া যায়। এক দিকে সরকারি দফতরকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে জেলায় জেলায় ছুটে বেড়ান মুখ্যমন্ত্রী। অন্য দিকে, তাঁর সরকার বাড়তি ছুটি দিয়ে টানা চার দিন অফিস বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করছে এ কেমন দ্বিচারিতা?” বেসরকারি ক্ষেত্রে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর ছুটি-নীতির প্রভাব তেমন নেই। আইটি সেক্টরের কর্মীরা হয় দোল, না হয় হোলি যে কোনও এক দিনই ছুটি পাচ্ছেন। তবে এঁদের অবস্থাটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতোই।

কেন এই হাল? আর কেন বারবার কল্পতরু মমতা?

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা একটা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাঁদের মতে, দুঁদে নেত্রী বিলক্ষণ জানেন, জনমোহিনী দাওয়াইয়ের কোনও বিকল্প নেই। তা সে আপাত-অবাস্তব রেল প্রকল্পই হোক, বা জামাইষষ্ঠীর ছুটি। এবং মমতা এ-ও জানেন, রাজ্যে কর্মসংস্কৃতির দায় তাঁর একার নয়। কর্মীদের মানসিকতার উপরেও তা কিছুটা বর্তায়।

আর তাই মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চিত, হোলির দিনটায় ৪২ শতাংশ বকেয়া মহার্ঘ ভাতা নিয়ে তাঁকে অনুযোগ করবে না কেউ!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন