টাকার খেলায় দফায় দফায় শিশু হাতবদল

হার মানে গরু-ছাগলের ব্যবসাও! টাকার বিনিময়ে বারবার শিশুদের হাতবদলের চক্রে সাধারণ দুষ্কৃতী, প্রেমিক সেজে মেয়েদের ভুলিয়ে ফাঁদে ফেলার চতুরচূড়ামণি বা চিকিৎসকের যোগসাজশটাও কম চমকপ্রদ নয়।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৩১
Share:

হার মানে গরু-ছাগলের ব্যবসাও! টাকার বিনিময়ে বারবার শিশুদের হাতবদলের চক্রে সাধারণ দুষ্কৃতী, প্রেমিক সেজে মেয়েদের ভুলিয়ে ফাঁদে ফেলার চতুরচূড়ামণি বা চিকিৎসকের যোগসাজশটাও কম চমকপ্রদ নয়।

Advertisement

কলকাতা থেকে কাঁথি, কাঁথি থেকে বরাহনগর পর্যন্ত জাল ছড়ানো এমনই একটি চক্র কী ভাবে শিশুদের হাতবদল করে ব্যবসা চালাত, তার হদিস পেয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। তদন্তে তাঁরা দেখেছেন, সদ্যোজাত সন্তানকে প্রথমে ৭৫ হাজার টাকায় এক শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল বাবা। কিন্তু তার পরে পরেই কলকাতার দক্ষিণ শহরতলি, উত্তর ২৪ পরগনা-সহ রাজ্য জুড়ে শিশু পাচার নিয়ে ধরপাকড় শুরু হওয়ায় প্রমাদ গোনেন সেই চিকিৎসক। কোনও ঝুঁকি না-নিয়ে লাভের আশা ছেড়ে তড়িঘড়ি ৪৭ হাজার টাকায় বরাহনগরের এক দম্পতির কাছে সেই নবজাতককে ফের বিক্রি করে দেন তিনি।

শুধু শিশু বিক্রি নয়, প্রেমের ফাঁদে ফেলে মেয়ে পাচারের কাজেও চক্রটি যে সিদ্ধহস্ত, তার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এপ্রিলে ভবানীপুরের এক কিশোরীর অন্তর্ধানের তদন্তে নেমেছিল পুলিশ। তাতেই শিশু পাচারের কথা জানা যায়। পুলিশ জানায়, ওই কিশোরীর ‘স্বামী’ পদ্মলোচন বেরা, সুমন হালদার নামে কাঁথির এক চিকিৎসক, একটি নার্সিংহোমের ম্যানেজার-সহ সাত জনকে পাকড়াও করা হয়েছে। শিশু পাচার নিয়ে সুমনকে জেরা করতেই একই শিশুকে দু’-দু’বার বিক্রি করে দেওয়ার কথা জানতে পারেন গোয়েন্দারা। পুলিশের অনুমান, চক্রটি দীর্ঘদিন ধরেই শিশু পাচারের কাজকারবার চালিয়ে যাচ্ছে। তাই বিপদ বুঝতে পেরে লোকসান সয়েই জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় নামে বরাহনগরের এক বাসিন্দা এবং তাঁর স্ত্রীর কাছে শিশুটিকে বিক্রি করে দেন সুমন। জয়ন্তকেও গ্রেফতার করা হয়েছে।

Advertisement

তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছিল, প্রথমে ওই কিশোরীর সঙ্গে প্রণয়-সম্পর্ক গড়ে তোলে পদ্মলোচন। তার জেরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়ায় মেয়েটি পদ্মলোচনের হাত ধরে ঘর ছাড়ে। তার পরে নাম-কা-ওয়াস্তে তাদের বিয়েও একটা হয়েছিল। শিশুর খোঁজ করতে গিয়ে কাঁথির ওই পাচার চক্রের সন্ধান পান তদন্তকারীরা। পদ্মলোচনকে জেরা করতেই চিকিৎসক সুমনের খোঁজ মেলে। আর সুমনকে পাকড়াও করার পরেই শিশু পাচার রহস্যের পর্দা উঠতে শুরু করে একের পর এক।

লালবাজারের খবর, অক্টোবরে কাঁথিতে পদ্মলোচনেরই চেনা একটি নার্সিংহোমে কন্যাসন্তানের জন্ম দেয় ওই কিশোরী। জন্মাবধি শিশুটি অসুস্থ ছিল। সুমনই তার চিকিৎসা করছিলেন। পুলিশ জানায়, উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য শিশুটিকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ‘রেফার’ করে দেন ওই চিকিৎসক। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজে না-এনে ওই নার্সিংহোমের ম্যানেজারের সাহায্যে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় সুমনের বাড়িতে। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘শিশুটিকে ওই ডাক্তারের কাছে বেচে দিয়ে ৭৫ হাজার টাকা পেয়েছিল পদ্মলোচন। নার্সিংহোমের ম্যানেজার, কর্মীরাও সেই টাকার ভাগ পেয়েছিল।’’

পুলিশ জানায়, সুমনের আদি বাড়ি কলকাতার গরফা এলাকায়। কাঁথিতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন তিনি। সেখানেই শিশুটিকে রাখা হয়েছিল। গত নভেম্বরে হঠাৎই রাজ্য জুড়ে শিশু পাচার চক্রের লোকজনকে ধরপাকড় শুরু করে সিআই়ডি। বেগতিক বুঝে শিশুটিকে তড়িঘড়ি বেচে দেওয়ার ছক কষেন সুমন। ওই চক্রেরই দুই সদস্যের মাধ্যমে খোঁজ মেলে বরাহনগরের বাসিন্দা জয়ন্তদের। ‘‘সাধারণত শিশু বিক্রি করে ২০-২৫ হাজার টাকা লাভ করত ওই চক্র। কিন্তু এ ক্ষেত্রে লাভ তো দূরের কথা, বিপদ এড়াতে বেশ কিছু টাকা লোকসান করেই কম টাকায় শিশুটিকে বেচে দেন সুমন। কম টাকায় শিশু পেয়ে কিনেও নেন ওই দম্পতি,’’ মন্তব্য এক পুলিশকর্তার।

পুলিশের সন্দেহ, এমন ভাবে আরও অনেক শিশুকেই বিক্রি করা হয়েছে। সুমনকে জেরা করে সেই সব কেনাবেচার হদিস পাওয়ার চেষ্টা চলছে। খোঁজ চলছে শিশু পাচার চক্রের অন্য দুই সদস্যেরও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন