প্রধান বিচারপতি গবইয়ের সংরক্ষণ নিয়ে বক্তব্যের প্রসঙ্গে বঙ্গের দলিত নেতাদের কী মতামত? গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
নতুন করে উঠে এল পুরনো বিতর্ক। বছরখানেক আগে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণিভুক্তদের (ওবিসি) সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তাঁর পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হয়েছিল। সেই প্রসঙ্গ টেনেই দেশের প্রধান বিচারপতি ভূষণ রামকৃষ্ণ গবই ফের তফসিলি জাতিভুক্তদের (এসসি) সংরক্ষণের প্রশ্নে অর্থনৈতিক মানদণ্ডের পক্ষে সওয়াল করলেন। চলতি সপ্তাহের শেষেই তিনি অবসর নেবেন। তার আগে তিনি যুক্তি দিলেন, এসসি-ভুক্তদের মধ্যে যাঁরা অবস্থাপন্ন, তাঁদের সংরক্ষণের আওতা থেকে বাদ দেওয়া উচিত। গবইয়ের এ হেন পর্যবেক্ষণ ‘বাস্তবসম্মত’ নয় বলে দাবি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের একাধিক রাজনৈতিক দলের তফসিলি, দলিত অংশের নেতানেত্রীরা।
গবইয়ের যুক্তি, ‘‘যদি এসসি-ভুক্ত কেউ আইএএস অফিসার হন, তা হলে তাঁর পরিবারকে সংরক্ষণের সুযোগ থেকে বাদ দেওয়া উচিত।’’ সম্প্রতি একটি আলোচনাসভায় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, একজন আইএএস অফিসারের সন্তান যে পরিসরে পড়াশোনা করেন, একজন সাধারণ ক্ষেতমজুর বা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকের ছেলেমেয়ে সেই স্বাচ্ছন্দ্য পান না। গবইয়ের কথায়, ‘‘এই বৈষম্য দূর হওয়া প্রয়োজন। আর তাই তফসিলি জাতির সংরক্ষণে অবস্থাপন্নদের বাদ রাখা উচিত বলেই মনে করি।’’
যা আদৌ ‘বাস্তবসম্মত’ নয় বলে মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন দলের এসসি-ভুক্ত নেতানেত্রীরা। এসসি সংরক্ষিত আরামবাগের তৃণমূল সাংসদ মিতালি বাগ যেমন স্পষ্টই বলছেন, ‘‘যে যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। এসসিদের মধ্যে কত জন আইএএস-আইপিএস অফিসার রয়েছেন?’’ একাধিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে, গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে উচ্চবর্ণের হাতে দলিত ও পিছিয়ে পড়া অংশের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার কথা। সেই প্রেক্ষাপটে বাস্তব অবস্থা এবং প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে ভিন্ন মেরুর হিসাবে অভিহিত করেছেন মিতালি।
বুধবার সংসদে সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক ছিল। সূত্রের খবর, সেই বৈঠকে গবইয়ের মন্তব্য নিয়ে সরাসরি আলোচনা না-উঠলেও একাধিক বিরোধী সাংসদ সরব হয়েছেন এসসি-ভুক্তদের বিষয়ে কেন্দ্রের রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এ-ও খবর যে, এক বিজেপি সাংসদ বৈঠকে অভিযোগ করেছেন, এসসি-ভুক্তদের বিষয়ে যে কাজ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে সাংসদেরাই অবগত থাকছেন না। মানুষ তা হলে কী ভাবে জানবেন? একাধিক সাংসদের বক্তব্য, স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে এই ধরনের স্বরের অর্থ এসসি বা অনগ্রসর অংশের জন্য নীতি গৃহীত হলেও তার বাস্তবায়নে ফাঁকফোকর থেকে যাচ্ছে।
রাজ্যের সামাজিক ন্যায় বিচার মঞ্চের নেতা তথা রানাঘাটের প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ অলকেশ দাসের বক্তব্য, ‘‘বিচারপতি গবই যা বলেছেন, তা শুনেছি। তিনি যে ধারণার কথা বলছেন, তার সঙ্গে বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। অবস্থাপন্ন বলতে তিনি যা বোঝাচ্ছেন, তেমন এসসিদের মধ্যে ক’ত শতাংশ? সেই তথ্য কেউ দিতে পারছেন না। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও এটাই বাস্তবতা।’’ তাঁর আরও বক্তব্য, ‘‘ওবিসিদের মধ্যে এটা করা হয়েছে। কিন্তু তার পরেও রোহিণী কমিশনের রিপোর্ট বলছে, ওবিসিদের মধ্যে ২২টি সম্প্রদায় কোনও সুযোগই পায়নি।’’ পশ্চিবঙ্গ দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি তথা বলাগড়ের তৃণমূল বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী আবার বিচারপতি গবইয়ের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে তিনি সার্বিক ভাবে মনে করেন, ‘‘দলিত সমাজকে খণ্ডবিখণ্ড করার জন্য নানা কৌশল নেওয়া হচ্ছে একেবারে উপরতলা থেকে। তার ধারাবাহিকতা আমরা দেখতে পাচ্ছি।’’
যদিও রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলের অনেকে বিচারপতি গবইয়ের বক্তব্যকে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চাইছেন। তাঁদের বক্তব্য, গবই নিজে দলিত অংশ থেকে উঠে এসেছেন। মহারাষ্ট্রের অমরাবতীর একটি পুরসভার স্কুল থেকে তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। তিনি সংরক্ষণের ধারণাকে আরও নিবিড় করতেই এ হেন পর্যবেক্ষণ রেখেছেন। কারণ, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, অবস্থাপন্ন পরিবারের এসসি-ভুক্ত কেউ যদি সংরক্ষণের সুবিধা পান আর অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া কোনও সাধারণ শ্রেণিভুক্ত কেউ যদি কেবল মাত্র এসসি নন বলে বঞ্চিত হন, তা হলে বনিয়াদি ধারণাই বাধাপ্রাপ্ত হয়।
অবসরের আগে সংরক্ষণ বিতর্ক নিজেই উস্কে দিলেন দেশের দ্বিতীয় দলিত প্রধান বিচারপতি।